বিভক্তি থেকে পুনরেকত্রীকরণ আজকের জার্মানি চার দশক ধরে বৈরিভাবাপন্ন দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল
আজকের জার্মানি চার দশক ধরে বৈরিভাবাপন্ন দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল৷ সাবেক পশ্চিম জার্মানিতে ছিল ফেডারেল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা আর পূর্ব জার্মানিতে ছিল এক দলীয় কমিউনিস্ট সরকার৷
প্রথম থেকেই দুই জার্মানির সম্পর্কে চলছিল টানাপোড়েন৷ পশ্চিম আর পুবের শীতল যুদ্ধের সময় দুই জার্মানির মধ্যে বৈরিতা চরম পর্যায়ে উঠেছিল৷ এর কয়েক বছর পর থেকে অবশ্য পূর্ব জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে চেষ্টা শুরু করে তখনকার পশ্চিম জার্মানি৷ নানা রকম উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে দুই দেশের কাছে আসার এই প্রচেষ্টা৷ যার পরিণতি - পূর্ব জার্মানির বিলুপ্তি ও দুই জার্মানির পুনরএকত্রীকরণ৷
সময়টা ছিল ১৯৮৯ সাল৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান তখন মিখাইল গর্বাচভ৷ পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, মুক্তমনা তিনি৷ পশ্চিম ও পূর্ব দুই জার্মানিই সফর করেন গর্বাচভ কয়েক মাসের ব্যবধানে৷
১৯৬১ সালের ১৩ই আগস্ট, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্লিন শহরের মাঝখানে রাতারাতি গড়ে তোলা হয় এক বিশাল প্রাচীর৷
১৯৮৯ সালের ১২ই জুন কোলন/বন বিমান বন্দরে মিখাইল গর্বাচভ তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের পাশে দাঁড়িয়ে যখন দুই দেশের জাতীয় সংগীত শুনছিলেন তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, কিছুদিন পরেই কী ঘটতে যাচ্ছে৷ মিখাইল গর্বাচভের বক্তৃতা বিবৃতি আলাপ আলোচনায় শোনা যায় তাঁর রাজনীতিতে একটা বড় রকমের সংস্কারের সুর৷ পশ্চিম জার্মানির মানুষের মন জয় করেন অমায়িক এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব৷ এর কয়েক মাস পরে ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র পূর্ব জার্মানি সফর করেন গর্বাচভ এবং ঘোষণা দেন, রাডিক্যাল পরিবর্তনের হাত এড়াতে পারবেনা এই দেশটিও৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের ২৩ শে মে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক জার্মানি আর পূর্বাঞ্চলে কমিউনিস্ট শাসিত ‘জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র'৷ পূর্ব জার্মানির ১ কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিকের শাসন ভার ন্যস্ত হল কমিউনিস্ট পার্টি এস ই ডি এর হাতে৷ তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন তথা সেসময়কার ক্ষমতাসীন শাসক স্ট্যালিনের প্রতি ছিল যাদের অগাধ আনুগত্য৷ শ্রমিক ও কৃষকের মঙ্গলে নিজেদের একটি উন্নত মানের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে প্রচারণাও শুরু করতে থাকে পূর্ব জার্মানির শাসকগোষ্ঠী৷ কিন্তু মানুষের অসন্তোষ ঠেকিয়ে রাখা যায়নি তাতে৷ ১৯৫৩ সালে বার্লিনে এক শ্রমিক বিদ্রোহ নির্মম ভাবে দমন করা হলে জনতার হতাশা আরো বাড়তে থাকে৷ দেশ ছাড়তে শুরু করেন দলে দলে৷ কিন্তু পূর্ব জার্মান কর্তৃপক্ষের প্রচারণা দমে থাকেনি৷ অচিরেই দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক জার্মানিতে পরিণত হবে এই প্রচারণাই চালাতে থাকেন তারা গোটা ৫০ এর দশক ধরে৷
পশ্চিম জার্মান সরকারের কাছে অবশ্য এই ধারণাটা ছিল অবাস্তব৷ আর তাই পাশাপাশি থেকেও দুই জার্মানির দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমেই৷ পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের দেশ ছাড়ার প্রবণতাও বাড়তে থাকে৷ ১৯৬১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিনই ২০০০ জন দেশ ত্যাগ করতে থাকেন৷ সব মিলিয়ে এই সংখ্যাটা ২৫ লক্ষেরও বেশি হবে৷ কমতে শুরু করে ডাক্তার, শিক্ষক ও ইন্জিনিয়ারের সংখ্যা৷ ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যায় পূর্ব জার্মান সরকারের৷
পূর্ব জার্মানির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেন মিখাইল গর্বাচভঃ ‘‘আমি মনে করি, বিপদ তাদের জন্যই অপেক্ষা করে, যারা সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেনা৷''
১৯৬১ সালের ১৩ই আগস্ট, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্লিন শহরের মাঝখানে রাতারাতি গড়ে তোলা হয় এক বিশাল প্রাচীর৷ দুই জার্মানির বিভক্তিটা এই ভাবেই পাকাপোক্ত করতে চাইলেন পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট শাসকগোষ্ঠী৷ এই বিভক্তির কারণে ২৮ বছর ধরে বহু পরিবার আত্মীয় স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন, অনেক শ্রমিক হারালেন কাজ৷ সীমানা পার হবার চেষ্টা করে ১০০০ এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারালেন৷
১৯৬৩ সালের শেষ দিকে দুই দেশের মানুষের যাতায়াত ও দেখা সাক্ষাৎ এর জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ এর পর প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ পূর্ব জার্মানিতে তাদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করেন৷
পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর ভিলি ব্রান্ড ১৯৬৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই দুই জার্মানির মধ্যে বৈরিতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন আন্তরিকভাবে৷ তিনি বলেনঃ ‘‘ফেডারেল জার্মান সরকারের পক্ষে পূর্ব জার্মানিকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব নয়৷ জার্মানিতে দুই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকলেও পরস্পরের কাছে তারা বিদেশ নয়৷ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশেষ ধরনের হতে পারে৷''
পশ্চিম জার্মানির সরকার প্রধান হিসাবে ভিলি ব্রান্ডই প্রথম পূর্ব জামানি সফর করেন৷ সেখানকার জনসাধাণ উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনা জানায় তাঁকে৷ দুই জার্মানির পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেন তিনি৷ সহিংসতা রোধ করা, দুই দেশের সীমান্তকে স্বীকৃতি দেয়া, রাষ্ট্রদূতের বদলে দুই দেশে স্থায়ী প্রতিনিধির আদান প্রদান করা এই সব বিষয় নিয়ে কথা বার্তা হয়৷ ১৯৭২ সালের ২১শে ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় একটি চুক্তি৷ কিন্তু দুই জার্মানির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার লক্ষণ ৭০ ও ৮০ এর দশকেও দেখা যায়নি৷
১৯৮৫ সালের ১১ ই মার্চ সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নে শীর্ষ নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন মিখাইল গর্বাচভ৷ জানান তাঁর রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির কথা৷ আশার আলো জেগে ওঠে পূর্ব জার্মানির বিরোধী দলের মনে৷
পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর ভিলি ব্রান্ড ১৯৬৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই দুই জার্মানির মধ্যে বৈরিতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন আন্তরিকভাবে৷
১৯৮৯ সলের অক্টবর মাসে পূর্ব জার্মানিতে দেশব্যাপী গণ আন্দোলনের ঢেউ জেগে ওঠে৷ মানুষ চায় একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, ভ্রমণের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সংস্কার৷ পূর্ব জার্মানির ৪০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে যে মানুষটি আমন্ত্রিত, সেই বন্ধুভাবাপন্ন মিখাইল গর্বাচভের কাছ থেকেই সাহায্যের আশা করেন তারা৷
১৯৮৯ সালের ৭ই অক্টবর, পূর্ব জার্মানির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেন মিখাইল গর্বাচভঃ ‘‘আমি মনে করি, বিপদ তাদের জন্যই অপেক্ষা করে, যারা সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেনা৷''
এর মাস খানেক পর পূর্ব জার্মান কর্তৃপক্ষ দুই জার্মানির মাঝে সীমানা খুলে দেয়৷ শুরু হয় যেন গণ জোয়ার৷ সময়টা ছিল ১৯৮৯ সালের ৯ ই নভেম্বরের রাত৷ পূর্ব বার্লিন থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন পশ্চিম বার্লিনে, দেখেন পর্যটক-আকর্ষক বিখ্যাত রাস্তা কুরফ্যুর্সটেনডাম, ক্যুডাম৷ অধিকাংশেরই জীবনে এই প্রথম পশ্চিমাঞ্চলে আসা৷ ‘সত্যি পাগল করা' ছিল সেই রাতটি৷