তার বড় পরিচয়টা কি- বঙ্গবন্ধুর জামাতা প্রধানমন্ত্রীর স্বামী, না একজন বিজ্ঞানী?

তার বড় পরিচয়টা কি- বঙ্গবন্ধুর জামাতা প্রধানমন্ত্রীর স্বামী, না একজন বিজ্ঞানী ?


আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী গত কয়েকদিন যাবৎ এই মৃত্যুটির আশংকার কথা দেশের আর কারোই অজানা ছিল না। এই সুদূর লন্ডনে বসেও জানতাম, ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার অসুস্থতা গুরুতরভাবে বেড়েছে। যে কোন মুহূর্তে তার মৃত্যু হতে পারে। এই আশংকার কথা জেনেই তার পত্নী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিকল্পিত কানাডা সফর বাতিল করেছেন। বিদেশে তার চিকিৎসা সফল হয়নি। দেশেও চিকিৎসকরা তার রোগ মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ওয়াজেদ মিয়া আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। রোগে ভুগছিলেন বহুদিন থেকে। তবে এত শিগগির তিনি চলে যাবেন, তা ভাবিনি। ৯ মে ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবে লেখাজোখার কাজ শেষ করেছি, এমন সময় পরপর দুটি মৃত্যু সংবাদ পেলাম- একটি আমাদের উলানিয়া পরিবারের এক তরুণ সদস্য ভুট্টোর। সম্পর্কে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র। ইন্নালিল্লাহ পড়ে সবে শোকের ধাক্কা কাটাচ্ছি- এমন সময় দ্বিতীয় টেলিফোন। দেশের একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আর নেই। আবার ইন্নালিল্লাহ পড়তে হল।আত্মীয় বিয়োগের চেয়েও এই শোক মনে বেশি ধাক্কা দিল। প্রথম শোকটি তো আমার পারিবারিক শোক। কিন্তু দ্বিতীয় শোকটি সারাদেশের। শেখ হাসিনা তার স্বামীকে হারিয়েছেন, আর দেশ হারাল একজন নির্লোভ দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীকে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হয়েও যিনি সেই সুযোগকে নিজের কোন সুবিধা আদায়ের কাজে লাগাননি এবং সরকারি কাজে কোন ধরনের প্রভাব বিস্তার করেননি। যে অভিযোগ থেকে ব্রিটেনের লৌহমানবী নামে খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের স্বামী মি. থ্যাচারও মুক্ত থাকতে পারেননি। বিশ্বের মহিলা প্রধানমন্ত্রীদের অনেকের স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী হিসেবে ড. ওয়াজেদ মিয়ার একটা পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য আছে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিসেস থ্যাচারের স্বামী মিস্টার থ্যাচার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং টোরি পার্টির নেত্রী মার্গারেটের স্বামী না হলে এবং সেই সুবাদে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে দীর্ঘকাল বাস না করলে দেশে-বিদেশে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে কেউ তাকে চিনত না। তিনি আমৃত্যু মিসেস থ্যাচারের স্বামী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ইন্ধিরা গান্ধী এবং বেনজির ভুট্টোর স্বামী সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। ইন্দিরা তার পিতা ও পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও অন্য সম্প্রদায়ের (পার্সি) ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করেছিলেন। ইন্দিরাকে বিয়ে না করলে ফিরোজ দেশে ও সমাজে কতটা পরিচিতি লাভ করতেন সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। মৃত্যুর আগে তিনি রাজনীতিতেও নেমেছিলেন, এমনকি পার্লামেন্ট সদস্য হয়ে শ্বশুর নেহরুর (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) বিরুদ্ধেও একবার অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও দেশময় তার পরিচিতি সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে ইন্দিরার স্বামী হিসেবে। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো একেবারেই অপরিচিত জারদারিকে বিয়ে না করলে জারদারির নামও কেউ জানত কিনা সন্দেহ। বেনজিরের নির্মম হত্যাকাণ্ড না ঘটলে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়াকে রাতের খোয়াব বলে মনে করতেন। বেনজিরবিহীনভাবে প্রেসিডেন্ট পদ এবং পিপলস পার্টির নেতৃত্ব তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেন কিনা সন্দেহ। এদিক থেকে বাংলাদেশে জাতির পিতার জামাতা এবং তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী হওয়া সত্ত্বেও এই পরিচয়ের বাইরে ওয়াজেদ মিয়ার একটা নিজস্ব পরিচয় ও অবস্থান আছে। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় অন্য অনেকের মতো শেখ মুজিবকে তিনি ’মুজিব ভাই’ ডাকতেন। তিনি পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের ভৌতবিজ্ঞান সদস্য ছিলেন এবং পরে চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ওয়াজেদ মিয়া একজন শক্তিশালী লেখকও। রাজনীতি, সমাজ ও বিজ্ঞানবিষয়ক তার গ্রন্থের সংখ্যা আটটি। তার লেখা “Fundamentals of Electromagnetics” and “Fundamentals of Thermodynamics” দেশে এবং বিদেশে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তার ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ নামক বিরাট বইটি একাধারে তার আত্মকথা এবং দেশের মুক্তিসংগ্রাম ও তার নায়ক সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য ইতিহাস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ’বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’। সুতরাং ওয়াজেদ মিয়া তার পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার দ্বারা নিজস্ব একটি পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই অন্য পরিচয়গুলো তার জন্য অলংকার হয়ে রয়েছে। তা নিয়ে তিনি কখনও অহংকার করতে চাননি, তার প্রয়োজনও বোধ করেননি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন ড. ওয়াজেদ মিয়াকে রসিকতা করে আমি একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম- আচ্ছা ওয়াজেদ মিয়া, আপনি তো অনেকগুলো পরিচয়ের বিরল সমমানে ভূষিত। যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জামাতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী এবং নিজে একজন খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী। এই তিনটি পরিচয়ের মধ্যে আপনি কোন পরিচয়ে বেশি পরিচিত হতে চান? ওয়াজেদ মিয়া হাসিমুখে জবাব দিয়েছিলেন, ’আমি বঙ্গবন্ধুর জামাতা পরিচয়ের জন্য গর্বিত। তবে প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমি যখন তাকে বিয়ে করি, তখন তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনার কথা আমার জানা ছিল না এবং হাসিনা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও ছিলেন না। আমি একজন বিজ্ঞানী বলে পরিচিত হতেই ভালোবাসি।’ ওয়াজেদ মিয়া সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে হলেও তার মনের আসল ইচ্ছাই ব্যক্ত করেছিলেন। হাসিনার সঙ্গে তার বিয়েতে কোন রোমান্টিকতা ছিল না বা কোন রাজনৈতিক পরিবারে বিয়ে করে তার বিশেষভাবে লাভবান হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল না। বরং তখন সরকারি রোষে পতিত এবং নানা মামলা-মোকদ্দমায় অভিযুক্ত ও কারাবন্দি এক জননেতার মেয়েকে বিয়ে করে তারও সরকারি রোষে পড়ার এবং তার ক্যারিয়ার ও চাকরি জীবনের ভয়ানক ক্ষতি হওয়ার আশংকা ছিল। আইয়ুবের গোঁ-ধরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান তো ঘোষণাই করেছিলেন, কোন সরকারি কর্মকর্তা শেখ মুজিবের মেয়েকে বিয়ে করলে তার চাকরি যেতে পারে। এজন্যই সরকার এই বিয়েতে কোন ধরনের বাধার সৃষ্টি করতে পারে- এ আশংকায় ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে হাসিনার বিয়ের আক্‌দ অনুষ্ঠান তড়িঘড়ি করে সম্পন্ন করা হয়েছিল।এ সম্পর্কে ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনার জবানিতে তার লেখা ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬) লিখেছেন, ’হাসিনাকে ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বরে আমাদের বিয়ের আকদ অনুষ্ঠান অতো তড়িঘড়ি করে কেন সম্পন্ন করা হয়েছিল সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সে আমাকে জানায়, ১৯৬৬ সালে আব্বা (মুজিব) কর্তৃক ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতি বিপুল জনসমর্থন দেখে গভর্নর মোনায়েম খার সরকার তখন দেশের বিভিন্ন শহর-গঞ্জে আয়োজিত জনসভায় তিনি যাতে ভাষণ দিতে না পারেন সেজন্য তাকে পরপর বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করতে থাকে এবং পরিশেষে পাকিস্তানের দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি করে রাখে। এরপর পরিবারবর্গের ওপর শুরু করা হয় নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন।’শেখ হাসিনা তার স্বামীকে আরও জানান, ’এহেন পরিস্থিতিতে আব্বা-আমমা চিন্তিত হয়ে আমার বিয়ে তড়িঘড়ি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে এক সিএসপির (ঈঝচ) সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ওই সময় গভর্নর মোনায়েম খাঁ সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমাকে (হাসিনাকে) কেউ বিয়ে করলে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হতে পারে। এ কারণে ওই ভদ্রলোকের পরিবারবর্গ এবং আত্মীয়-স্বজনও একটু ইতস্তত করছিলেন। তাছাড়া ভদ্রলোকের দাড়ি ছিল, যে কারণে ওই প্রস্তাবে আমি বেশি খুশি ছিলাম না। অতঃপর ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। আমার বিয়ে সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রস্তাব আসে বিদেশ থেকে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ডিগ্রি নিয়ে আসা এক ভদ্রলোকের পরিবারের কাছ থেকে। ভদ্রলোকটি আমার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো হওয়ায় আমি ওই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হইনি। এরপর আসে তোমার (ওয়াজেদ মিয়া) সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব। তোমার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হওয়ায় আমি বেশ কিছু চিন্তা করে এতে রাজি হলাম। তাছাড়া তুমি একজন পরমাণু বিজ্ঞানী জেনে মনে মনে আমি বেশ খুশিও হয়েছিলাম।’ (পৃষ্ঠা ৩৬)।প্রেম না হলেও শেখ হাসিনা পছন্দ করেই ড. ওয়াজেদ মিয়াকে বিয়ে করেছিলেন। এক্ষেত্রে ওয়াজেদ মিয়ার নির্লোভ পছন্দ এবং সাহসকেই আমি বাহবা দেই। একজন বন্দি রাজনৈতিক নেতার মেয়েকে বিয়ে করে তার যে কোন আশু লাভ নেই বরং সরকারি রোষে পড়ে তার ক্যারিয়ার ও চাকরির গুরুতর ক্ষতি হতে পারে একথা জেনেও তিনি শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেছিলেন এবং এই পরিবারটির চরম দুর্দিনে, এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও দীর্ঘকাল বিদেশে স্ত্রীর সঙ্গে কষ্ট ও যন্ত্রণাময় নির্বাসিত জীবন বেছে নেয়ার যে ধৈর্য ও সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন, আর কোন কারণে নয়, এই একটিমাত্র কারণে তার চরিত্রের অন্য কোন মানবিক দোষত্রুটিকে আমি কিছুমাত্র গুরুত্ব দেইনি এবং এখনও দেই না। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে চলে আসায় অবশ্যই ওয়াজেদ মিয়ার পারিবারিক জীবনে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাঝে মাঝে মতান্তর সৃষ্টি হওয়াও কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। এর সুযোগ নিয়ে বিএনপি সরকার তাকে উচ্চ সরকারি পদ, এমনকি রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে তার পারিবারিক জীবনে ভাঙন সৃষ্টি এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন খতম করে দেয়ার বহু চেষ্টা করেছে। যদি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন খতম করে দেয়া সম্ভব হতো তাহলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শিবির শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে এতদিন ভেঙে যেত, বাংলাদেশে পাকিস্তানি স্টাইলে সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তির রাজত্ব স্থায়ীভাবে কায়েম হতো।ওয়াজেদ মিয়া এ সত্যটা সুনিশ্চিতভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সব দুঃখ-বেদনা সবসময় সহ্য করেছেন (মাঝে মাঝে হয়তো সহ্য করতে পারেননি)। কিন্তু সেজন্য দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মর্যাদায় ও রাজনীতিতে যাতে কোন আঘাত না লাগে সেজন্য কখনও অশুভ শক্তির কোন প্রলোভনের ফাঁদে পা দেননি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মর্যাদা রক্ষা এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি তার সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখেছেন। অকালে রোগগ্রস্তও হয়েছেন। শেখ হাসিনা স্বইচ্ছায় রাজনীতিতে আসেননি। ভাগ্য তাকে রাজনীতিতে ঠেলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যার পর তিনি যদি আওয়ামী লীগের হাল শক্তভাবে না ধরতেন, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে সংগ্রামে না নামতেন তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা আজ কী দাঁড়াত তা বুঝতে গবেষণার দরকার হয় না। দেশ ও জাতির প্রতি এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকেও সাংসারিক ও পারিবারিক সুখ-শান্তি বিসর্জন দিতে হয়েছে। হাসিনার মনেও এ দুঃখ ও বেদনাবোধ কম নয়।রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গেলে পারিবারিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা যায় না এবং এ সমস্যা বিশ্বের সব নারী রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের বেলায়ও ঘটেছে। মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, বেনজির ভুট্টো প্রমুখকেও তাদের পারিবারিক জীবনের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিতে হয়েছে। মার্গারেটের স্বামী মি. থ্যাচার এজন্য কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করেননি বরং একবার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ’আমি আমার স্ত্রী ম্যাগির কাছে কৃতজ্ঞ। সারারাত কেবিনেটের ম্যারাথন মিটিং করার পরও ক্লান্ত শরীরে সে এখনও আমার জন্য বেড টি তৈরি করে এবং আমাকে এনে দেয়। এটি সে বিয়ের পর থেকেই করে আসছে এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও করছে।’ শেখ হাসিনা রাজনীতিতে নামা এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও যতটা সম্ভব স্বামী ও পুত্র-কন্যার প্রতি কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছেন। সবটা পারেননি, সেটা সম্ভবও নয়।১৯৯৩ সালে আমি যখন দীর্ঘকাল পর ঢাকায় যাই, তখন ওয়াজেদ মিয়ার ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তিনি নিজে এসে আমাকে তার বইটি দেন এবং জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত বইটির প্রকাশনা উৎসবে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। আমি একটু দেরি করে গিয়ে দেখি, বক্তৃতাপর্ব অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। ড. মুনতাসীর মামুন এবং আতাউস সামাদের বক্তৃতা শোনার সুযোগ আমার হয় এবং আমিও আলোচনায় অংশগ্রহণ করি। ওয়াজেদ মিয়া নিজে এসে আমাকে মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওয়াজেদ মিয়ার একান্ত আশা ছিল শেখ হাসিনা এ সভায় আসবেন। কিন্তু হঠাৎ সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি আসতে পারেননি। ওয়াজেদ মিয়া সভা শেষে আমাকে বিদায় দিতে এসে আমার কাছে একটি মনোবেদনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি ইন্দিরা-ফিরোজের জীবনের একটি ঘটনার কথা জানেন? বলেছি, কোন ঘটনাটি? ওয়াজেদ মিয়া বলেছেন, ইন্দিরার স্বামী তো অকালে মারা যান। তিনি যখন অসুস্থ তখন রাজনৈতিক কাজের চাপে ইন্দিরা স্বামীর পাশে থাকতে পারেননি। মৃত্যুর সময় ফিরোজ গান্ধীর ঠোঁটে ছিল ইন্দু ইন্দু এ ডাকটি। এ গল্পটি আমি জানতাম না। তাই তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আজ ইন্দিরা-ফিরোজের কথা আপনার মনে পড়েছে কেন? ওয়াজেদ মিয়া বলেছেন, মাঝে মাঝে আমার ভয় হয় আমিও হয়তো অকালে মারা যাব, তখন হাসিনা পাশে থাকবে না। ওয়াজেদ মিয়ার মনের এ আশংকাটি সত্য হয়নি, একথা আজ নিঃসংকোচে বলতে পারি। হাসিনা রোগাক্রান্ত স্বামীকে ফেলে রেখে কানাডায় যাননি এবং তার মৃত্যুর সময় স্বামীর কাছাকাছিই ছিলেন। ড. ওয়াজেদ মিয়ার অকাল মৃত্যু শুধু হাসিনার জন্য নয়, আমাদের জন্য, দেশের জন্যও একটি বড় ক্ষতি।


লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট - লন্ডন প্রবাসী

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা