তিয়েনআনমেন হত্যাকান্ডের ২০ বছর
কমিউনিস্ট পার্টির নীরবতা
তিয়েনআনমেন হত্যাকান্ডে ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তা আজো অজানা৷ তবে ধারণা করা হয়ে থাকে যে, ৫০০ থেকে ১০০০-এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়৷ বিক্ষোভকারীদের নৃশংসভাবে দলনের ছবি দেখে ক্ষুব্ধ হয় সারা বিশ্বের মানুষ৷ কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সেই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে এখনও নীরব৷
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সরাসরি সম্প্রচার
তিয়েনআনমেন চত্বরে চীনা সৈনিকদের রক্তক্ষয়ী দমন অভিযান ঘটেছিল বিশ্ববাসীর চোখের সামনে৷ প্রবল বিস্ময়ে হতবাক মানুষ তার ছবি দেখেছিল টেলিভিশনের পর্দায়৷
এমনিতে তখন বেইজিং-এ স্থায়ী রিপোর্টার ছিল খুব কম মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের৷ কিন্তু শহর ছিল সাংবাদিকে ভরা৷ কেননা তখনকার সোভিয়েত নেতা মিখায়েল গর্বাচভ তাঁর ঐতিহাসিক চীন সফরে গিয়েছিলেন ১৯৮৯ সালের মে মাসে৷ ৩০ বছরে সেটাই ছিল কোন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম চীন সফর৷ গর্বাচভ চীন ত্যাগ করার পরও বেশ কিছু সাংবাদিক বেইজিং-এ থেকে যান৷
ছাত্রদের লাগাতার বিক্ষোভ ও অনশন
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই তিয়েনআনমেন চত্বর ছিল গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের দখলে৷ দূর্নীতির বিরুদ্ধে, আইনের শাসনের তীব্র অভাবের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার হয় বিক্ষোভরত ছাত্ররা৷ অনশন ধর্মঘটে নামে বহু ছাত্র৷ তখনকার চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান ঝাও জিয়াং বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেন৷ অনুরোধ করেন তাদের অনশন ভাঙতে৷ কিন্তু তার পাঁচ ঘন্টা পর ক্ষমতাচ্যুত হন ঝাও৷ কেননা সামরিক কায়দায় গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের স্বত:স্ফূর্ত আন্দোলন দমনের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী৷ তাই তাঁকে সরে যেতে হয়৷ ২০০৫ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ঝাং ছিলেন গৃহবন্দী৷
১৯শে মে বেইজিং-এ জারি করা হয় সামরিক আইন৷ অবশেষে চৌঠা জুন চীন সরকার শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়৷
নৃশংসভাবে দমন করা হয় ছাত্রদের অহিংস বিক্ষোভ তৎপরতা৷ বিদেশী সাংবাদিকরা সরাসরি তার খবর ছড়িয়ে দেন সারা পৃথিবীতে৷
প্রত্যক্ষদর্শী ঝাং জিয়ান
১৯৮৯ সালের সেই ছাত্র বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বেইজিং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটির ছাত্র ঝাং জিয়ান৷ তখন তাঁর বয়স ১৮৷ কীভাবে চীনা সৈন্যরা গুলি চালিয়েছিল, ট্যাংক নিয়ে চড়াও হয়েছিল নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর, স্বচক্ষে দেখেন তিনি৷ তাঁরই পাশে গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় এক ছাত্রের রক্তাক্ত দেহ৷ ঝাং পালিয়ে যান নি৷ বরং প্রবল ক্রোধে মুখোমুখি হন সৈনিকদের৷ সেই ভয়ংকর ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি টিশার্ট খুলে চিৎকার করে বলি, করো গুলি, চালাও গুলি! সেই মুহূর্তে আমি বোধহয় আমার জীবন দিতে পারতাম৷ ওদের কাছে আমরা যেন মানুষ নই, আমরা যেন আগাছা৷ সেই আগাছাই নির্মূল করছে ওরা৷ ওদের বললাম, আমরা চীনারা অত সস্তা নই৷ ছোট্ট কুকুর নই যে ভয়ে কুঁকড়ে যাব৷ একজন অফিসার ততক্ষণে বন্দুক তাক করেছে আমার দিকে৷ বললাম, করো গুলি! সঙ্গে সঙ্গে গুলি এসে লাগে আমার ঊরুতে’৷
তিন তিনটে গুলি খেয়েও প্রাণে বেঁচে যান ঝাং৷ ১২ বছর অন্য নাম নিয়ে তিনি আত্মগোপন করে থাকেন৷ ২০০১ সালে পালিয়ে চলে আসেন প্যারিসে৷ চীনে বিরুদ্ধ মতের মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত ইনটারনেট কনফারেন্স-এর আয়োজন করেন তিনি৷ চীনা শাসকদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে চান ঝাং জিয়ান৷
ঝাও জিয়াং-এর স্মৃতিকথা
সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের আন্দোলন দমনের বিরোধিতা করেছিলেন সে সময় যে চীনা নেতা, সেই ঝাও জিয়াং ২০০৫ সালে মারা যান৷ আমৃত্যু তাঁর কাটে গৃহবন্দি দশা৷ তিয়েনআনমেন হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কারা দায়ী, কীভাবে ঘটেছিল সেই ভয়ংকর ট্র্যাজেডি, তার বিস্তারিত তথ্য তিনি গোপনে গোপনে রেকর্ড করে রাখেন ক্যাসেটে৷ আস্থাভাজনদের সহায়তায় সেই ক্যাসেট
ঝাও জিয়াং
পাচার হয়ে যায় বিদেশে৷ সেই স্মৃতিচারণই ইতিমধ্যে বই হিসেবে প্রকাশিত৷ শিরোনাম: রাষ্ট্রের হাতে বন্দি - ঝাও জিয়াং-এর স্মৃতিকথা৷
গণতন্ত্রই সেরা ব্যবস্থা: ঝাও
চীনা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই এই স্মৃতিকথা প্রকাশিত৷ ঝাও নৃশংস হাতে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার সিদ্ধান্তের জন্য মূলত দায়ী করেছেন চীনের সংস্কারপন্থী নেতা দং শিয়াও পিং এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী লি পেং-কে৷ ঝও-এর অভিযোগ, তাঁরাই পলিটব্যুরোর সম্মতি না নিয়েই গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ ঝাও ক্যাসেটে ধরা তাঁর বক্তব্যে এমনকি পশ্চিমের মডেলে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাঁর মতে, ‘পশ্চিমের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবচেয়ে প্রাণশক্তিময় ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত৷ যা আছে তার মধ্যে এই ব্যবস্থাই হল সেরা’৷