ঐতিহাসিক দুই স্থান সংরৰণের নির্দেশ

ঐতিহাসিক দুই স্থান সংরৰণের নির্দেশ ০ স্থান চিহ্নিতকরণে ৩ মাসের মধ্যে কমিটি গঠন
ঐসব স্থানের সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করতে হবে

"রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালস্নাহ। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’-১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত এই ভাষণকে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসাবে উলেস্নখ করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে পরিসি'তিতে যেভাবে এই অবিস্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন, তার কোন তুলনা ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় না। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই ভাষণের স'ান এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যে সকল ঐতিহাসিক স্থান ও বধ্যভূমি রয়েছে, তা সংরৰণের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এছাড়া এই সকল স্থান চিহ্নিত করার জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই সকল ঐতিহাসিক স্থান ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করার পর সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে ঐতিহাসিক স্থানগুলো সর্বো"চ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সংরৰণ ও জাতীয় ও আনৱর্জাতিক মানের স্মৃতিসৱম্ভ নির্মাণ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া দেশী ও বিদেশী নাগরিকগণ বিনা বাধায় যেন এগুলো পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে তার সুবন্দোবসৱ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রদত্ত ভাষণের স্থান ও ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান চিহ্নিতকরণ ও সংরৰণের নির্দেশনা চেয়ে গত ২৫ জুন হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব:) কেএম শফিউলস্নাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। ঐ দিন হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রম্নল জারি করেন। গত দু’দিন রিট মামলার রম্নলের ওপর চূড়ানৱ শুনানি গ্রহণ করে গতকাল বুধবার বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সকল সেক্টর কমান্ডারগণ তাদের জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সকলকে স্বাধীনতার পুরস্কার প্রদান করা উচিত।
এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার পদক প্রদান করে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে উলেস্নখ করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু নিজেই সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জাতির পিতা। তিনি বাংগালি জাতির স্রষ্টা। তিনি বাংগালি জাতির স্বাধীনতার প্রতীক। তার নামে স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছে। তিনি স্বাধীনতা পদকের অনেক ওপরে অবস্থান করেন। এই পদক দিয়ে তাকে অবমূল্যায়ান করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে জাতির জন্ম এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সে জাতি জন্মের স্বীকৃতি লাভ করেছে। স্থানে এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেই স'ানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদি কেউ বাংগালি হয়ে থাকে, তাহলে ঐ স'ানে দাঁড়িয়ে তার প্রাণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে। এছাড়া চোখ বন্ধ করে চিনৱা করবে এইখানে জেনারেল একে নিয়াজী তার বাহিনীসহ বাংগালি জাতির সম্মুখে আত্মসমর্পণ করেছিল। রায়ে বলা হয়, বাংগালি জাতির বিজয় ও স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই দুইটি স্থান সংরৰণ করা সকলের সাংবিধানিক ও আইনগত দায়িত্ব। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, এই রেসকোর্স উদ্যান অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাৰ্য বহন করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর ছাড়াও ২৩ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯, ১০ জানুয়ারি ও ১৭ মার্চ ১৯৭২ বা আরো অন্য কোন তারিখ যদি জাতীয় উন্মেষের স্মৃতি বহন করে তা সংরৰণ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রায়ে বলা হয়, এইসব ঐতিহাসিক স্থান ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরৰণ করা উচিত। এইসব স্থান যদি সংরৰণ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম কখনোই আমাদের ৰমা করবে না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিশ্বের সকল সভ্য জাতি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে। আমরা এতদিনেও পারিনি। যা আমাদের সাংবিধানিক ব্যর্থতা। সংবিধানের ২৩ ও ২৪ অনুচেছদ উলেস্নখ করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ৭ মার্চের ভাষণ ও ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের স্থান রাষ্ট্র কখনোই সংরৰণের ব্যবস্থা নেয়নি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ইহা তাদের সাংবিধানিক ব্যর্থতা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ সংবিধানের সকল আইন রৰা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের বিফলতার কারণে হাইকোর্ট এই রিট আবেদন গ্রহণ করেছে। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষণের নানা দিক উলেস্নখ করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল অসাধারণ। ইহা শ্রেষ্ঠ ভাষণ। উইনষ্টন চার্চিল প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে বসে তার সেই বিখ্যাত ভাষণ দেন; কিন' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১০/১৫ লাখ লোকের সামনে এই ৭ মার্চের ভাষণ দেন। যা তাদের মনের কথা ছিল। যে কারণে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না করা হলেও জনতা মোটেই আশাহত হননি, তারা তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলেন, এটাই তাদের স্বাধীনতার ডাক। এছাড়া ‘একটি জাতির জন্ম’ নামক প্রবন্ধে তদানীনৱন লে. কর্নেল পরে মেজর জেনারেল জিয়াউল রহমান লিখেছেন, এই ভাষণ ছিল আমাদের জন্য গ্রীন সিগন্যাল। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। যেই যুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত হয়েছে। এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন জাতীয় চার নেতা। আর ৭ মার্চের মন্ত্রকে কার্যকর রূপ দেন এই জাতীয় চার নেতা। নয় মাসের রক্তৰয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ বিসর্জন, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠন, এই ত্যাগ, রক্ত ও অশ্রম্নর বিনিময়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। রিট মামলায় রম্নলের চূড়ানৱ শুনানিতে আবেদনকারিগণের পৰে এডভোকেট মনজিল মোরশেদ, সরকার পৰে এটর্নি জেনারেল এডভোকেট মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এডভোকেট এম কে রহমান, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মোসৱফা জামান ইসলাম বক্তব্য প্রদান করেন। এছাড়া রিট আবেদনকারিগণের বক্তব্য সমর্থন করে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র কৌঁসুলি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট এএফএম মেসবাহউদ্দিন ও সম্পাদক এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম এবং এমিকাস কিউরি হিসাবে ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া আদালতের নিকট তাদের মতামত প্রদান করেন। রিট মামলায় হাইকোর্ট দুই রিট আবেদনকারীরও বক্তব্য গ্রহণ করেন।
প্রতিক্রিয়া:
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, হাইকোর্টের এই রায়টি বাংগালি জাতির এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অসিৱত্বের উতসমূলকে সংরৰণের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনা করেছে। কারণ, বাংগালি জাতি ও বাংলাদেশ সৃষ্টির নব উন্মেষ যেখানে ঘটেছিল তা রৰা করা না হলে জাতির অতীত পরিচয়টুকু এক সময় মুছে যেতে পারে। মুনতাসির মামুন বলেন, এই রায়ে আমি শুধু আনন্দিত নই, অভিভূত। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে আমরা এজন্য সংগ্রাম করেছি; কিন' মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অৰুণ্ন রাখতে পারেনি। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা সকলেই এই রায়কে স্বাগত জানাবেন। অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, এই রায় যুগানৱকারী। যারা বাংগালি জাতিসত্তাকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে তা দূর হবে।
ঐতিহাসিক স্থান সংরৰণ
একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল কমিটি এবং মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দৰিণ এশীয় গণ সম্মিলন’ এর নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, হাইকোর্টের এই রায় আইনের ইতিহাসে মাইলফলক হিসাবে বিরাজ করবে। অতীতে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত শত্রম্নরা ৰমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মারক বিকৃত ও বিলুপ্তকরণের যে চক্রানৱ করেছিল হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সেই সব নিদর্শন পুনরম্নদ্ধার ও সংরৰণে সহায়ক হবে। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, বিগত বছরগুলোতে ৭১’এর অধিকাংশ বধ্যভূমি স্বার্থান্বেষী মহল দখল করে বিভিন্ন ধরনের সংস্থপনা নির্মাণ করেছে। আমরা আশা করব, এবার বেদখল হওয়া বধ্যভূমিগুলো দখলমুক্ত করে সেগুলো যথাযথভাবে সংরৰণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম রব্বানী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা