পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান তার সহধর্মিনী ও রাজনীতির নেপথ্য প্রেরণাদাতা শেখ ফজিলাতুন্ন

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান তার সহধর্মিনী ও রাজনীতির নেপথ্য প্রেরণাদাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
মাকে নিয়ে লিখেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা... ....
মাত্র তিন বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হয়। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক, মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ কাশেম চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের (বয়স ১১) সঙ্গে ফজিলাতুননেছার বিবাহ দেন। তার সমস্ত সম্পত্তি দুই বোনের নামে লিখে দেন। বড় বোন জিন্নাতুননেছার বয়স ৭ বছর এবং ফজিলাতুননেছার বয়স ৫ বছরের সময় মায়ের মৃত্যু হয়। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুননেছাকে শাশুড়ি কোলে তুলে নেন এবং নিজের সন্তানদের সঙ্গে লালন-পালন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। তখনকার সামাজিক রীতি অনুযায়ী বয়স দশ বছর হলে স্কুলে পাঠানো সামাজিকভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকার কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বাড়িতে পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য মৌলভী এবং বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল। পরিবারের সকল শিশু-কিশোর বিশেষ করে মেয়েরা বাড়িতেই শিক্ষা গ্রহণ করত। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। পরবর্তী জীবনে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন। স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালী নারী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী শান্ত, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন। জীবনে কোন চাহিদা ছিল না, কোন মোহ ছিল না। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। এমন কি ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনও পিতৃ সম্পত্তির থেকে বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন। তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। গরীব আত্মীয়-স্বজনদের যে কোন অর্থনৈতিক সংকটে মুক্ত হস্তে দান করেছেন। সংগঠনের নেতা কর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে অর্থসাহায্য করা, ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য সাহায্য সব সময়ই করতেন। বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, পরিবার-পরিজনদের খোঁজ খবর রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা ইত্যাদি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি করতেন। আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় কর্মীদের সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনও রিক্ত হাতে ফিরে যেত না। অনাথ এতিমদের তিনি সব সময় সাহায্য করতেন। রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে স্বামীর পাশে থেকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। যেহেতু স্বামী ব্যস্ত থাকতেন কাজেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সব দায়িত্বই তিনি নিজের হাতে নিয়েছিলেন। স্বামীর আদর্শে অনুুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে তোলেন। মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর গোয়েন্দা সংস্থা বেগম মুজিবকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ (ইন্টারোগেশন) করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। ছায়ার মত অনুসরণ করেছেন স্বামীর আদর্শকে বাস্তবায়ন করবার জন্য। জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন। অনেক কষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জীবনের সব থেকে সুন্দর সময়গুলো কারান্তরালে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করা, প্রতিটি কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন নেপথ্যে থেকে। তাঁর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল, আন্দোলন চলাকালের প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাতকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সে নির্দেশ জানাতেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। আবার আওয়ামী লীগের কার্যকরি সংসদের সভা ধানমণ্ডি ৩২ নং সড়কের বাড়িতে চলাকালে নিজের হাতে রান্না-বান্না করতেন এবং তাদের খাদ্য পরিবেশন করতেন। এই সংগঠনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করবার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চক্ষু বাঁচিয়ে সংগঠনকে সংগঠিত করতেন, ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ, রাত একটার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নং সড়কের বাড়ি আক্রমণ করে প্রচণ্ড গুলি-গোলা চালায় এবং পর দিন অর্থাৎ ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় আবার বাড়ি আক্রমণ করে, শেখ জামাল, রাসেলকে নিয়ে বেগম মুজিব ওই বাড়িতে ছিলেন। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেখ কামাল ২৫ শে মার্চ রাত্রে ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চলে যায়। পিতার গ্রেপ্তার হবার সংবাদ পেয়ে কামাল কার্ফুর ভিতরেই গেরিলা কায়দায় ৫০টি বাড়ির দেয়াল টপকে সন্ধ্যায় মাকে দেখতে আসে। বাড়ি আক্রমণ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেয়াল টপকে সন্তানদের নিয়ে বেগম মুজিব পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনী তাঁকে খুঁজতে থাকে। দিনের পর দিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লুকিয়ে লুকিয়ে দিন কাটান। অবশেষে একদিন হানাদার বাহিনী তাঁকে মগবাজারের একটা বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ধানমণ্ডির ১৮ নং রোডের একটা বাড়িতে এনে বন্দি করে রাখে। বন্দি অবস্থায় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক মানসিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার ভোগ করেন। ১৭ই ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির উপরে হানাদার বাহিনী কর্তৃক টাঙ্গিয়ে রাখা পাকিস্তানী পতাকা ছিড়ে টুকরো টুকরো করেন, পা দিয়ে মাড়ান ও আগুন লাগিয়ে দেন। নিজেই জয়বাংলা শ্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় হাজার হাজার মানুষ বাড়িতে ছুটে আসতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে জামাল ফিরে আসে, পরে কামাল আসে। তখনও বঙ্গবন্ধুর কোন খবর জানা যায়নি। এক বুক ব্যথা নিয়ে, আশঙ্কা ভরা মন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তখনও তিনি জানেন না-স্বামী জীবিত আছেন কিনা, ফিরে আসবেন কি না? সে সময়টা ছিল তাঁর জীবনে সব থেকে কঠিন সময়। অবশেষে ৮ই জানুয়ারি বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে প্রথম জানা গেল যে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন। বাসায় জরুরি ভিত্তিতে টেলিফোন লাগানো হল। প্রথম ফোনে গলার আওয়াজ শুনলেন। তার পর থেকে স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসা পর্যন্ত হাতে তসবিহ ও জায়নামাজেই সময় কাটালেন। ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। প্রথমেই গেলেন তাঁর প্রিয় জনতার মাঝে, পরে এলেন পরিবার পরিজনের কাছে। বেগম মুজিব আশ্রয় পেলেন স্বামীর বিশাল বুকে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর পাশে থেকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি সংসার গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করলেন বেগম মুজিব, পাশাপাশি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও স্বামীকে সহযোগিতা করতে সচেষ্ট হলেন। বিশেষ করে লাঞ্ছিতা মা-বোনকে সহযোগিতা করা, তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে গিয়ে সাত্ত্বনা দেওয়া ও সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। ধীরে ধীরে অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদা সম্পন্ন জীবন দান করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সর্বদা স্বামীর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে যান। দেশ ও দেশবাসীর জন্য সমগ্রজীবন তিনি আত্মত্যাগ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে নির্মমভাবে খুনিরা হত্যা করে। হত্যার পর বেগম মুজিবকেও হত্যা করে। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তার শরীর ঝাঝরা হয়ে যায়, তিনি লুটিয়ে পড়েন শোবার ঘরের দরজার সামনে। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ঘটে। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী মরণকালেও সঙ্গী হয়ে রইলেন। সারাটা জীবন তিনি শুধু ত্যাগই করে গেছেন। প্রয়োজনে নিজের গহনা বিক্রি করে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারই আত্মত্যাগের মহিমায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রয়েছে অবদান। মৃত্যুর কোলে ঘাতকের আঘাতে তিনি ঢলে পড়লেন। একজন মুসলিম নারী হিসেবে যা তার প্রাপ্য তাও তো তিনি পাননি। কাফন-দাফনটুকুও তাঁদের দেওয়া হল না। রক্তাক্ত পরনের কাপড় নিয়ে শহীদী মৃত্যুবরণ করলেন। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধুদের সঙ্গে একই সাথে চলে গেলেন। নীরবে তিনি করে গেলেন কত বড় আত্মত্যাগ বাংলার মানুষ কি তাঁর কথা মনে রাখবে? ফেলবে কি দু'ফোটা অশ্র" এই মহতী নারীর জন্য। কবি নজরুলের কবিতায় "রাজা করিছে রাজ্য শাসন বাজারে শাসিছে রাণী, রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে, রাজ্যের যত গ্লানি"। তিনি অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, মনোবল প্রেরণা যুগিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন স্বামীকে। তাই তো বাংলার মানুষ পেয়েছে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। পেয়েছে আত্মপরিচয়ের সুযোগ। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে একটি দেশ। আত্ম-পরিচয়ের সুযোগ পেয়েছে একটি জাতি। দিনের পর দিন চলে যায়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরে যায়, যুগের পর যুগ �কিন্তু জাতি হিসেবে আত্ম পরিচয়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য কত রক্ত ঝরেছে, কত অশ্র" বিসর্জন হয়েছে। নীরবে কত আত্মত্যাগের কাহিনী ঘটে গেছে। কে কতটুকু সে খবর রাখে? আজ বাংলার মানুষ যে স্বাধীনতা পেয়েছে তার জন্য কত মানুষের কত অবদান সব কি জানা গেছে? না যায়নি। কত অব্যক্ত কথা রয়ে গেছে। যে ঘটনা ঘটেছে, যে কাহিনী পর্দার আড়ালে রয়েছে তার কতটুকু আর লিখে প্রকাশ করা যায়। লেখার মধ্য দিয়ে কতটুকুই বা বোঝা যায়? এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের কাছে একটি আকুল আবেদন রইল� তারা যেন একবার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে এই না বলা ইতিহাস, না জানা কথা।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day