৭২ এর সংবিধান বাঙালির জাতীয় বিশ্বাসের দলিলঃ লন্ডনে সংবিধান দিবসের সেমিনারে আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

৭২ এর সংবিধান বাঙালির জাতীয় বিশ্বাসের দলিলঃ
লন্ডনে সংবিধান দিবসের সেমিনারে আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
ভিওবিডি, লন্ডন থেকেবাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের ৩৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনে আয়োজিত ’আজকের বাস্তবতায় ৭২ এর সংবিধানের প্রয়োজনিয়তা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বলেছেন, ৭২ এর সংবিধান বাঙালির জাতীয় বিশ্বাসের পবিত্র দলিল। এই দলিলকে যারা নষ্ট করেছে তারা জাতীয় শত্রু। তিনি বলেন, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার, বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষতাকে এভাবেই সজ্ঞায়িত করেছিলেন যা ৭২ এর সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ব। র্মনিরপেক্ষতাই সকল নাগরিকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। জনাব চৌধুরী উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে জাতীয় অস্থিত্বই যে হুমকির মুখে পড়ে তার সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ পাকিস্তান। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাবার মত সাহসি হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, এই সরকারের মেয়াদের মধ্যেই ৭২ এর সংবিধান পূনঃপ্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ফিরিয়ে নিতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু করতে হবে। তিনি ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান দিবসকে প্রি ত বছর সরকারী ভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি আহবান জানান। ১৬ নভেম্বর, সোমবার, বিকালে বাংলাদেশের প্র ম সংবিধান প্রণয়নের ৩৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ব লন্ডনের মন্টিফিউরী সেন্টারে ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ, ইউকে চ্যাপ্টার (একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখা) আয়োজিত এক সেমিনারে অতিথি আলোচকের বক্তব্যে জনাব আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী উপরোক্ত মন্তব্য করেন।সেমিনারে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ, ইউকে চ্যাপ্টারের সভাপতি ডাঃ বি বি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে সমমানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ডঃ এম. সাইদুর রহমান খান। অতিথি আলোচক হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম নেতা মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম শফি উল া, কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সভাপতি সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার এবং লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার গিয়াস উদ্দিন। যুক্তরাজ্য নির্মূল কমিটির পক্ষে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের অন্যতম উপদেষ্টা সাংবাদিক আবু মুসা হাসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পাদক আহাদ চৌধুরী বাবু।মলূ আলোচকের বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন ৭২ এর সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হলে বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধীদের চারণ ক্ষেত্র হতো না। ৭২ এর সংবিধান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ট সংবিধান। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে এই আধুনিক প্রগতিশীল সংবিধানটিকেও হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি সদ্য স্বাধীন দেশে অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটি আধুনিক সংবিধান প্রণয়ণ তৎকালীন বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়ছিল। সংবিধানের মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল বাঙালির দীর্ঘদিনের আকাঙ্খার প্রতিফলন। রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রেখে রাষ্ট্রের উপর সকল ধর্মের মানুষের অধিকার যেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধ,ু ঠিক তেমনি ভাবে গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্রকেও মূলনীতি হিসেবে রেখে তিনি প্রমান করেছিলেন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একে অপরের পরিপুরক। তৎকালীন সময়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্র না থাকায় বঙ্গবন্ধুর এই নতুন দর্শনও বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। শাহরিয়ার কবির বলেন, বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক এই সংবিধানটিকে বার বার কাটা ছেড়া করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িকতাকে নির্বাসনে দিয়ে সংবিধানটিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংবিধানে পরিণত করার চেষ্টা হয় ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে । তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর যাবতই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ৪ঠা নভেম্বরকে সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ বছর দেশের বাইরের বিভিন্ন শাখাও দিবসটি পালন করছে।সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার বলেন, একটি অশুভ মহলের স্বার্থেই ৭২ এর সংবিধানকে বার বার কাটা ছেড়া করে বাংলাদেশকে আজ জঙ্গি রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একাধিক দল এবং সরকারও এই অপকর্মে মদদ দিয়েছে। তিনি বলেন, ৭২ এর সংবিধান শুধু পূণঃপ্রতিষ্ঠাই নয়, যারা আমাদের এই পবিত্র দলিল কে ধর্ষণ করেছে তাদেরও বিচার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম শফি উল্লা বলেন, ৭২ এর সংবিধানের অনুপস্থিতির কারনেই সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধীরা আজ এত শক্তিশালী। সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়া যতদিন নিষিদ্ধ ছিল ততদিন জামাতের মত যুদ্ধাপরাধী দল মাথা তুলতে পারেনি। এই সংবিধানকে ধ্বংস করার মাধ্যমেই শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের পুনঃর্বাসন।তিনি প্রবাসী বাঙালিদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, যে যার অবস্থান থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করুন, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমেই আমাদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে । সাবেক হাইকমিশনার গিয়াস উদ্দিন স্বল্প সময়ে রচিত ৭২ এর সংবিধানকে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আশা আকাঙ্খার দর্পণ আখ্যায়িত করে বলেন, ভারতের প্র ম সংবিধান রচনা করতে সময় লেগেছিল ৫ বছর, পাকিস্তানের ৯বছর। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১১ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সংবিধানটি রচিত হয়েছিল সেটি স্বীকৃতি পেয়েছিল বিশ্বের অন্যতম একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল সংবিধান হিসেবে। এখানেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।সমমানিত অতিথির বক্তব্যে হাইকমিশনার ডঃ এম সাইদুর রহমান খান বলেন, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের আজকের বিপদজনক উত্থান ৭২ এর সংবিধানের অনুপস্থিতিরই ফল । ৭২ এর সংবিধান অনুসারে দেশ পরিচালিত হলে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধীদের চারণ ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ অস্থিতিশীল হতো না। তিনি বলেন, সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন হতেই পারে, তবে সংবিধানের মূল স্তম্বগুলো ঠিক রেখেই তা করতে হয়। হাইকমিশনার সেমিনারে উপস্থিত সূধীজনদের আশ্বস্থ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রি পার্লামেন্টে ইতোমধ্যে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আশাকরি সবার সমিমলিত প্রচেষ্ঠায় এটি সম্ভব হবে। তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় নিতে বর্তমান সরকার সম্ভব সব কিছু করবে বলেও প্রবাসীদের আশ্বস্থ করেন।অনুষ্ঠান শেষে আলোচকরা উপস্থিত সূধীজনদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সেমিনারে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার গুরুত্বপণূর্ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারের শেষ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানবাধিকার কর্মী আব্বাস ফয়েজ কিছুক্ষনের জন্য এসে বক্তাদের বক্তব্য শোনেন।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day