'একদিন গুলি একটা আমার বুকে লাগবে আর একটা বঙ্গবন্ধুর'

'একদিন গুলি একটা আমার বুকে লাগবে আর একটা বঙ্গবন্ধুর'

গোলাম মর্তুজা অন্তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক ঢাকা, নভেম্বর ১৮ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হয়েছেন শুনেই ত্রস্ত হয়ে প্রথমে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও পরে রক্ষীবাহিনী প্রধানকে ফোনে জানানোর চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দীন আহমেদ। এরপর কারও অপেক্ষা না করেই ব্যক্তিগত গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। বাড়ির অল্প দূরেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। বনানীর ভাড়া বাসায় বুধবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিনের সেই ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিলেন তার স্ত্রী সাবেক সাংসদ আঞ্জুমান আরা জামিল। আঞ্জুমান আরার কাছে সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। দুঃসহ সেই দিনের ক্ষতগুলো এখনো সমান তাজা। কথা বলতে বলতে তাই কখনও কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আবার কখনও হচ্ছিলেন উত্তেজিত। তখন (পঁচাত্তরে ) জামিলউদ্দীনের চার মেয়ের মধ্যে বড়জনের বয়স ছিলো ১৫ বছর আর একদম ছোটটি তখনও পৃথিবীর মুখ দেখেনি। এরপর চার মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ শুরু হয় আঞ্জুমান আরার। তার অভিযোগ, তখনকার সরকারগুলো সাহায্য তো করেইনি, উল্টো পেছনে লাগিয়ে রেখেছিল 'টিকটিকি'। গণভবনেই স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে থাকতেন কর্নেল জামিলউদ্দীন। ১৫ আগস্ট তাকে হত্যার পরই স্ত্রী-সন্তানদের এক কাপড়েই গণভবন ছেড়ে যেতে হয়। তারা ওঠেন জামিলের বড়ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসায়। বঙ্গবন্ধুকে কখনও 'ফাদার', কখনও 'বঙ্গবন্ধু' সম্বোধন করতেন কর্নেল জামিল। "তিনি যে কেন গণভবনে থাকেন না!" এভাবে মাঝে-মধ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করতেন জামিল। জবাবে দরাজ গলায় আশ্বস্ত করতেন বঙ্গবন্ধু "তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? বাঙালি আমাকে মারবে না।" তবুও শঙ্কিত থাকতেন জামিল। বলতেন, "আমি জানি একদিন গুলি একটা আমার বুকে লাগবে আর একটা বঙ্গবন্ধুর বুকে।" "তাইতো হলো। তার প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে চার সন্তানসহ অকুল পাথারে ভাসিয়ে অকালে চলে গেলো," দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন আঞ্জুমান আরা। ওইদিনের ঘটনার বর্ণনায় আঞ্জুমান আরা বলেন, "সকালে বঙ্গবন্ধুর বাসার পথে বেরিয়ে যাওয়ার পর সোবহানবাগ মসজিদের সামনের রাস্তায় কিছু সৈনিককে কমান্ড করছিলেন তিনি। আঞ্জুমান আরা জানালেন, এক সময় মেজর হুদা (বজলুল হুদা) তাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। আমি তার লাশ দেখেছি। পুরো ঝাঁজরা হয়ে গেছে। গাড়ির গায়েও অসংখ্য গুলির চিহ্ন ছিল।" এত দুঃখেও গর্ব করে তিনি বলেন, "একমাত্র তিনিই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যদি না যেতেন তবে পুরো বাঙালি জাতিই পিতৃহত্যার দায়ে কলঙ্কিত হতো। অন্তত একজনতো পিতাকে বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন।" আগরতলা থেকে ১৫ আগস্ট... আঞ্জুমান আরা জানালেন, '৬৮-'৬৯ এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় কর্নেল জামিলউদ্দীনের কথা প্রথম বঙ্গবন্ধুর কানে যায়। জামিলউদ্দীন তখন ঢাকায় আইএসআই'র (পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা) প্রধান ছিলেন। সেসময় দেশের প্রতি জামিলের আনুগত্য দেখেই তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বলে জানান আঞ্জুমান আরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরলে নিজের সামরিক উপদেষ্টা বানিয়ে তাকে কাছে টেনে নেন বঙ্গবন্ধু। কষ্টের দিনলিপি... ১৫ আগস্টই গণভবন থেকে কর্নেল জামিলউদ্দীনের পরিবারকে বের করে দেওয়া হয়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, পেটে অনাগত শিশু আর তিনটি শিশু সন্তানকে নিয়ে কোনও রকমে গিয়ে ভাসুরের বাড়িতে ওঠেন আঞ্জুমান আরা। সেখানে থাকেন নয়মাস। এরপর অনেক আবেদন করে সরকারের কাছ থেকে মাসিক দেড়শ' টাকায় মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে একটি বাড়ি (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) ভাড়া নেন তিনি। সেখানে থাকেন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। শুরু করেন ইট-বালু আর ঠিকাদারি ব্যবসা। এরপরে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ সরকারের আমলে বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে খেই হারিয়ে ফেললেও ধীরে ধীরে পরে নিজের অবস্থান শক্ত করেন আঞ্জুমান আরা তিনি। একসময় শুরু করেন ইণ্ডেন্টিং ব্যবসা। সেই সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তার খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ করে আঞ্জুমান আরা বলেন, "উল্টো হয়রানি করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে। তবে পরিবার আগলে রেখেছিল বলেই এখনও টিকে রয়েছি।" শুধু পাওনাদি আর রেশন দিয়েছে সরকার। এছাড়া 'শহীদ'এর পরিবার হিসেবে কখনও কোনও সাহায্য পাননি তিনি। পরে বিভিন্নরকম হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানালেন জামিলপত�ী। "জিয়ার সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমাকে জ্বালাতন করতো। একবার সন্তানদের নিয়ে ভারতে আজমীর শরীফে যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে যাওয়ার পর আমাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। অনেক চেষ্টা করে পাসপোর্ট ফেরত পেলেও কলকাতা থেকে আজমীর শরীফ পুরো সময়টা আমাদের পেছনে গোয়েন্দা লেগে ছিলো।" নিরাপত্তা... কীসের? বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য সাংসদ তাপসের ওপর হামলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুগত জামিলউদ্দীনের পরিবার হিসেবে অনিরাপদ বোধ করছেন কী না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "কীসের নিরাপত্তা। সরকার, পুলিশ বা কেউতো আমাকে সাবধান হতে বলেনি। আমি আর ক'দিনই বা বাঁচবো।" তবুও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় হচ্ছে শুনে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। তবে, "জীবনতো কষ্ট করে পার হয়ে গেল। এখন আর রায়ে কী হবে বলেন। আমি কী বলবো।"

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা