শেষ হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর


শেষ হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর


খোন্দকার মুহম্মদ খালেদ ।।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। দু’ হাজার নয় সালের উনিশে নভেম্বর। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর তিন মাস চার দিনের ব্যবধান। এই তিন দশকের প্রায় পুরো সময়টাই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য এক বিশাল প্রতীৰার প্রহর। অবসান হল তাঁর সেই দীর্ঘ প্রতীৰার। এই প্রতীৰা যে কত দুঃসহ, কত বেদনাসংকুল, তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছোট্ট একটি পংক্তিতেই দৃশ্যমান-‘সময় ছুটে আসি, মনে বাসি ভয়- এসে দেখি যায় নাই তোমার সময়।’
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কঠিন দুঃসহ সময়ের এক ঐতিহাসিক অধ্যায় পার করলেন। এই সময়টা যে কি যন্ত্রণাময়, বেদনাকাতর ও সংগ্রামমুখর ছিল, তা তাঁর এই সুদীর্ঘকালের যাত্রা পরিক্রমা থেকেই দেদীপ্যমান। পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট রাতে শেখ হাসিনা ছিলেন ব্রাসেলসে তদানীনৱন রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাস ভবনে। এর আগে তিনি মূলতঃ শিশুপুত্র জয়ের তার বাবার কাছে যাবার জেদের কাছে নতি স্বীকার করেই বোন রেহানাকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানীর ফ্রাংকফুর্টে যান ৩০ জুলাই। ফ্রাংফুর্ট থেকে সোজা ড. ওয়াজেদ মিয়ার কার্লসরম্নয়ে শহরের বাসা। ৯ আগস্ট সে সময়কার পশ্চিম জার্মানীর রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে তিনি বনে যান। এরপর বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের আতিথ্যে ব্রাসেলস, আমস্টারডামসহ কয়েকটি জায়গায় ঘোরাফেরা করেন। ১৪ আগস্ট রাতে তিনি বোন রেহানাসহ সপরিবারে সানাউল হকের ব্রাসেলসের বাসায়ই কাটান। ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী জাহাঙ্গীর সাদতের বাসায় ঐ রাতে তিনি নৈশভোজ সারেন। জাহাঙ্গীর সাদতের স্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনার সহপাঠিনী। কাজেই রাত বেশ ভালই কাটলো। তখনো কি তিনি জানতেন, পরদিন কী ভীষণ সংবাদ তাঁর জন্য অপেৰা করছে?
১৫ আগস্ট তাদের প্যারিস যাবার কথা। প্যারিস স্বপ্নের শহর। সৌন্দর্যের শহর। মোনালিসার শহর, ল্যুভর মিউজিয়ামের শহর তথা বিশ্বের কালোত্তীর্ণ শিল্প ও স্থাপত্য শিল্পের তীর্থ শহর। ওখানে গিয়ে কত মধুর সময় কাটানোর স্বপ্ন ছিল ওদের। কিন্তু ১৫ আগস্ট ভোরে খান খান হয়ে গেল সব স্বপ্ন। একটি টেলিফোনই ওলোট-পালট করে দিল সবকিছু। কূটনীতিক বন্ধুদের সূত্রে জানা যায়, বিপদের এই চরম মুহূর্তে সে সময়ে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, বন দূতাবাসের তারেক করিম, ব্রাসেলস দূতাবাসের জাহাঙ্গীর সাদত তাদের কূটনৈতিক প্রোটোকল ভুলে গিয়ে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টানৱ রেখেছিলেন। অন্যদিকে কোন কোন কূটনীতিকের আগের দিনের রূপ ভুলে গিয়ে পরের দিনেই চোখ উল্টিয়ে নেয়ার চিত্রও নাকি দৃশ্যমান ছিল। যা হোক, এরপর বন, নয়াদিলস্নী। শুরম্ন হল শেখ হাসিনার দীর্ঘ যাত্রা, প্রতীৰা আর পরবাসের পালা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকা ফেরার চূড়ানৱ সিদ্ধানৱ গ্রহণের আগ পর্যনৱ শেখ হাসিনা সমসৱ শোককে ধীরে ধীরে শক্তিতে পরিণত করেছেন। তিনি জানতেন, সামনে তাঁর কঠিন দিন। তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবেননি কখনো। তাঁর আপাদমসৱক চিনৱা ছিল জাতিকে নিয়ে। কিভাবে এ দুর্ভাগা জাতিকে সেনা শাসনের জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত করা যায়। তিনি জানতেন, সংগঠন ছাড়া কোন স্বপ্নই বাসৱবে রূপ দেয়া সম্ভব নয়। তাই সব সংশয় ঝেড়ে ফেলে স্থিরচিত্তে দলের কাণ্ডারী হওয়ার শক্ত সিদ্ধানৱও নিলেন এক পর্যায়ে। যদিও তিনি জানতেন-‘দুর্গম গিরি কানৱার মরম্ন, দুসৱর পারাবার, লংঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’
দেশে ফিরে নতুন করে শুরম্ন করলেন তিনি তাঁর নবঅধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন। ১৯৮১-র ৩০ মে চট্টগ্রামে বিদ্রোহী সেনা সদস্যের আক্রমণে নিহত হলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এলেন আরেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি সেনা প্রধান থেকেই রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করলেন।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের আরেক অধ্যায় শুরম্ন হল। শুরম্ন হলো এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর এরশাদ সাহেব পদত্যাগ করেন প্রবল রাজনৈতিক গণআন্দোলনের মুখে। এরই ফলশ্রম্নতিতে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ৰমতায় আসে। পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচনের মাধ্যমে ৰমতায় আসে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা প্রত্যৰ ও পরোৰভাবে হত্যা করেছে, তারা তো এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। তাই ৯১-৯৫ শাসনামলে কেউ এ হত্যাকাণ্ডের বিচার আশা করেনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট তদানীনৱন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক একটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কোন প্রকার বিচারের পথও রম্নদ্ধ করে যান। ইতিহাসের ঘৃণীত ও কালো এ অধ্যাদেশটির নাম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথে এটি ছিল প্রথম বাধা।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ৰমতায় এসেই উদ্যোগ নেন ইতিহাসের জঘন্যতম কালো আইন বাতিলের। সংসদ অধিবেশনে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় তিনি এ অধ্যাদেশটি বাতিলে সৰম হন। এটি ছিল তার স্থির লৰ্য অর্জনের পথে একটি প্রথম সাফল্য। তিনি স্বচ্ছতা ও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বিশেষ ট্রাইবুনালের পরিবর্তে সাধারণ আইনে করার ব্যবস্থা করেন। তিনি ভাল করেই জানতেন, এ সিদ্ধানৱ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নিজ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, দৃঢ়চিত্ততা, ধৈর্য আর প্রজ্ঞাই তাঁকে সেদিন এ সিদ্ধানৱ নিতে সাহায্য করেছিল। তবে এ পথ কুসুমাসৱীর্ণ ছিল না মোটেই।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি আবার ৰমতায় আসে। পুরো পাঁচটি বছর ফের অপেৰার প্রহর গুনতে হয় শেখ হাসিনাকে। বিএনপি শাসনামল গেল। কিন্তু অগণতান্ত্রিক শাসন আবার চেপে বসলো। দু’টো বছর আরো নষ্ট করলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অবশেষে দৃশ্যতঃ কৃষ্ণ পৰের অবসান হল। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার দায়িত্বে এলো।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজে এতদিনের যত বাধা আর স্থবিরতা তার সবটাই দূর হলো। বিচার তার আপন গতিতে চললো। বিচারের রায় হল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আজকের এই ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে শেষ হল শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রতীৰার প্রহর। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের এই রায়ের দ্বারা দেশে আইনের শাসন কায়েমের একটি আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার দেয়ালই শুধু অপসারিত হল না, অনৱতঃ একটি ৰেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রশাসনিক প্রজ্ঞা, লৰ্যের প্রতি অবিচল আস্থা ও দৃঢ়তা, মানবিক সহনশীলতা ও ধৈর্যের যে পরাকাষ্ঠা দেখালেন তা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আরো সমৃদ্ধ হয়ে দেশের সার্বিক কল্যাণে বৃহত্তর অবদান রাখুক, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা এই দিনে।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা