১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়

১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়


আগামী ১৯ নভেম্বর বহু প্রতীক্ষিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের রায় ঘোষণা করা হবে।
নিয়মিত আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি ৫ আসামির আপিলের ওপর গত ৫ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। ২৯ কার্যদিবসব্যাপী একটানা শুনানি গ্রহণ করে আদালত। গতকাল বৃহসপতিবার আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের বক্তব্য গ্রহণ শেষে বিচারপতি এম তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ রায় ঘোষণার দিন ধার্যের আদেশ প্রদান করেন। এরপর উভয়পক্ষের কৌঁসুলিদের উদ্দেশে আদালত বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা অক্লানত পরিশ্রম করেছেন। আইন-কানুন তুলে ধরে এই আদালতকে সাহায্য করেছেন। এর আগে রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিষ্পত্তির জন্য অনেক মরুভূমির ভেতর দিয়ে হেঁটেছি। আজ মনে হচ্ছে এই বিচারালয় হলো মরু উদ্যান। আর তা দুইপক্ষের জন্যই সমান। তিনি আদালতের উদ্দেশে বলেন, আপনারা (বিচারপতিগণ) উভয়পক্ষের বক্তব্য ধৈর্য ধরে শুনেছেন। আর এই মামলায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। এর আগে আসামিপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান ও অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। আদালত থেকে বেরিয়ে এটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। ১৯ নভেম্বর রায় প্রদান করা হবে। সমগ্র জাতি আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এই মামলার বিচারের রায় শোনার জন্য। অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রত্যাশা করি এমন একটি রায়ের যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দৃষ্টানত হয়ে থাকবে। অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। আশা করি ন্যায় বিচার পাব। ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ৩৪ বছরের মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আজ বিচার শেষ হওয়ার দ্বারপ্রানেত এসেছি। সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে ১৯ নভেম্বরের দিনটির অপেক্ষায় আমিও থাকব। কারণ আজও আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি।
ন্যায় বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আসামিপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান বলেন, বিচার করার দায়িত্ব আদালতের। আর আমি তো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই। হত্যাকারীদের পক্ষে মামলা লড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খান সাইফুর রহমান বলেন, রোগীর কষ্টে ডাক্তারের কষ্ট হয় না। রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের যে সম্পর্ক, একজন উকিলের সঙ্গে তার মক্কেলের একই সম্পর্ক। শুধু চিকিৎসা একটাই- মামলা থেকে যেন সে অব্যাহতি পায়।
৫ যুক্তির ওপর আপিলের শুনানি অনুষ্ঠিত
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেছিল ৫টি যুক্তি বিবেচনায়। যুক্তিগুলো হচ্ছেঃ (১) বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ’সেনা বিদ্রোহ’ না ’হত্যাকাণ্ড’ (২) এই মামলায় সাক্ষীদের বক্তব্য পরসপরবিরোধী কিনা (৩) মামলা দায়েরে বিলম্ব স্বাভাবিক বলে নিম্ন আদালতের পর্যবেক্ষণ যথার্থ কিনা (৪) হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের আওতায় পড়ে কিনা (৫) হাইকোর্টের দ্বিধাবিভক্ত রায় নিষ্পত্তিতে তৃতীয় বিচারক পুরো রায় বিবেচনা করার পরিবর্তে ৬ জনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ভুল করেছেন কিনা।
২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় নিয়মিত আপিল। গত ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। উক্ত আদেশ অনুযায়ী গত ৫ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে শুরু হয় নিয়মিত আপিলের শুনানি।
বিরতি ছাড়া একটানা ২৯ দিন রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের কৌঁসুলিগণ তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন আদালতে। আদালত এই ৫টি যুক্তির ওপর কৌঁসুলিগণের বক্তব্য গ্রহণ করেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম, প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ, অ্যাডভোকেট এএফ এম মেসবাহ উদ্দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এছাড়া তাদের সহায়তা করেন একাধিক আইনজীবী।
অপরদিকে সৈয়দ ফারুক রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেমদের (আর্টিলারী) পক্ষে অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের পক্ষে অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান এবং বজলুল হুদা ও একে মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন আপিল পরিচালনা করেন।
এই আপিল শুনানি গ্রহণ করার জন্য গত ৪ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এমএম রুহুল আমিন আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির সমন্বয়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। বিচারপতি এম তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আব্দুল আজিজ, বিচারপতি বিকে দাস, বিচারপতি মো. মোজামেমল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মোশতাক সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। রুদ্ধ করা হয় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ। এর মধ্যে পেরিয়ে যায় ২১টি বছর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ঐ বছরের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। উন্মুক্ত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ। উল্লেখ্য, যে দিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়, ঠিক তার ১৩ বছর পর একই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নিয়মিত আপিলের শুনানি শেষ হলো। দিন ধার্য করা হলো চূড়ানত রায় প্রদানের জন্য।
উল্লেখ্য, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (বরখাসত) সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মহিউদ্দিন আহমেমদ (আর্টিলারী), একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদার লিভ টু আপিল ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মঞ্জুর করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে লিভ টু আপিলের শুনানি শুরু হয়। ২৬ কার্যদিবসব্যাপী শুনানি গ্রহণ করে আদালত। কারা অনতরীণ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি ২০০১ সালের ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল দায়ের করেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি লে. কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিনকে (ল্যান্সার) দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কারাগার থেকে ২০০৭ সালের ২৪ জুন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল দায়ের করেন।
ঘটনাপঞ্জিঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ৯ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় আসামি করা হয় ২৩ জনকে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ গোলাম রসুল দীর্ঘ ১৫১ কার্যদিবসে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা। উক্ত আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণে হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতি বিব্রতবোধ করেন। পরে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। এরপর হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহামমদ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ৩ জনকে নির্দোষ ঘোষণা করেন।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা