ওরা আমাকে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে : আবদুল জলিল
ওরা আমাকে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে : আবদুল জলিল
সোহেল হায়দার চৌধুরী
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মো. আবদুল জলিল এমপি ওয়ান ইলেভেনের পর যারা রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে, তাদের বিরম্নদ্ধে আবারো সংসদীয় তদন্ত দাবি করে বলেছেন, যারা তারসহ রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিনা কারণে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, প্রাণের ভয় দেখিয়ে স্বজনদের জিম্মি করে তাদের মতো করে কথা বলতে বাধ্য করেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া দরকার। নতুবা সুযোগ পেলেই অগণতান্ত্রিক শক্তি আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করতে চাইবে।২০০৭ সালের ২৮ মে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার হন আবদুল জলিল। প্রায় দেড় বছর তিনি বন্দি ও প্যারোলে ছিলেন। গত সোমবার তার গ্রেপ্তার ও পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে তিনি কথা বলেছেন যায়যায়দিনের সঙ্গে। আবদুল জলিল বলেন, এখনো তাকে ওই সময়ের দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। মাঝে মধ্যে সে সময়ের কথা মনে এলে চোখ জলে ভরে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে। তিনি জানেন না কী অপরাধ ছিল তার? গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখা? অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা নাকি অগণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা? নিজের গুলশানের বাসভবনে বসে সফেদ চুলের বর্ষীয়ান এ নেতা বলেন, চোখ-হাত বেঁধে অজ্তত স্তানে নিয়ে দিনের পর দিন তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। চরম দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। বারবার গায়ে হাত তুলতে চেয়েছে। থাপ্পড় মেরে সব দাঁত ফেলে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। জেলখানায় যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে চিকিতসার বদলে নির্যাতনের জন্য। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিজন সেলে থাকা অবস্থায় কর্নেল আফজাল ও কর্নেল সাঈদ রাত ২টার পর আসতেন। সারারাত ঘুমাতে দিতেন না। স্ত্রী-সন্তাদের নির্যাতনের ভয় দেখাতেন। বলতেন তাদের তুলে নিয়ে যাবেন। জীবনেও মুক্তি দেয়া হবে না। প্রতিটি মুহূর্তে চাপ দিতেন নেত্রী শেখ হাসিনার বিরম্নদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ লিখে দিতে হবে।ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সাবেক মন্ত্রী আবদুল জলিল বলেন, ২০০৭ সালের ২৮ মে দুপুরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কার্যালয়ে সেনাবাহিনীর সাত-আট মেজর ও কর্নেল র্যাঙ্কের লোক যান। তারা তাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। তারা নিজেদের যৌথবাহিনীর লোক পরিচয় দেন। জিজ্ঞাসা করেন তার বিরম্নদ্ধে কি অভিযোগ। বলেন জানেন না। উপরের নির্দেশ আছে। তিনি তাদের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে রেস্টরুমে ঢোকেন বাথরুম সারার জন্য। তারাও সেখানে ঢোকেন। তিনি এর প্রতিবাদ জানালে তারা রেস্টরুমে গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি বাথরুম, সেরে তার স্ত্রীকে ফোন করে সব বিষয় জানান। তিনি তখন নওগাঁয়। তিনি রেস্টরুম থেকে বের হলে ওই লোকগুলো তাকে কর্ডন করে নিয়ে নিচে নামে। প্রথমে একটা গাড়িতে ওঠানোর পর সঙ্গে সঙ্গে সেটা থেকে নামিয়ে আরেকটি গাড়িতে ওঠায়। চোখ বেঁধে দেয় কালো কাপড়ে। তিনি চোখে ব্যথা পাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় একজন কাউকে জিজ্ঞাসা করলেন হ্যান্ডকাফ লাগাবে কি না। অফিসার গোছের কেউ একজন বললেন দরকার নেই। তিনি সব শুনছেন, কিছু দেখছেন না বা কাউকে চিনতে পারছেন না। গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিজিএফআইর ইন্টারোগেশন সেলে। নামামাত্রই শুরু হলো নানা প্রশ্ন। একের পর এক প্রশ্নের তীর ছুড়ে দেয়া হচ্ছে তার দিকে। তিনি তাদের প্রশ্নবাণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। পরদিন তাকে কোর্টে চালান দেয়া হয়। কোর্ট থেকে নেয়া হয় রিমান্ডে। শুরু হয় নতুন করে প্রশ্নের পালা। নেত্রী (শেখ হাসিনা) সম্পর্কে, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে। কখনো কখনো বিশ্রী ভাষায় তারা নানা কথা বলতেন। তখন তাদের কথাবার্তা ও আচরণে মনে হতো তারা বোধহয় অন্য গ্রহের মানুষ, অন্য দেশের মানুষ। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করেছেন, সে দেশের মানুষ নন তারা।তাকে জিজ্ঞাসা করা হতো দলের টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসে। নেত্রীর টাকা-পয়সা কোথায় কোথায় আছে। বিদেশে কোনো টাকা-পয়সা বা বাড়ি আছে কি না। বলতেন, দল চালান কোন বিদেশি দূতাবাসের টাকা দিয়ে। শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন দেশ রাজনীতির জন্য কতো টাকা দেয় ইত্যাদি বিচিত্র এবং রুচিহীন নানা প্রশ্ন। তিনি বলতেন, আওয়ামী লীগ বিদেশের টাকা দিয়ে চলে না। সারাদেশে আওয়ামী লীগের কোটি কোটি নেতা-কর্মীর টাকা দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ চলে। শেখ হাসিনার বিদেশে কোনো টাকা নেই বা বাড়ি নেই। নির্যাতনকারীরা বলতেন, তার কথা ঠিক নয়। তিনি তখন তাদের বলতেন যদি জানেন ঠিক নয়, তাহলে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো ট্রাম্পকার্ডের কি ইতিহাস। তিনি বললেন, ট্রাম্পকার্ড মানে ফাইনাল স্ট্রাইক। গণবিরোধী সরকারকে সতর্ক ও সন্ত্রস্থ করে দেয়ার জন্য, সরকারের অবৈধ কাজে বাধা দেয়ার জন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করার লৰ্য নিয়ে ট্রাম্পকার্ড নামক একটি রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হয়েছিল। কিন' তারা তার কোনো কথা ভালোভাবে শুনতে চাইতেন না। বারবার চাপ দিতেন তারা যা বলতে চায় বা তাদের যা উদ্দেশ্য তা তাকে দিয়ে বলাতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তাকে দিয়ে নেত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলিয়ে তাকে নাজেহাল ও গ্রেপ্তারের গ্রাউন্ড তৈরি করা। আর এজন্য তারা জঘন্য আচরণ করেছে তার মতো একজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে। একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আবদুল জলিল। চোখে জল চিকচিক করছে। ঠোঁট কাঁপছে। দম নিয়ে বললেন, একদিন ট্রাম্পকার্ড সম্পর্কে নতুন গল্প ফাঁদার জন্য তার সামনে নিয়ে আসা হলো ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুকে। তাকে বলা হলো, তিনি যাতে মিন্টুকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করেন। শুধু তার কথা শুনবেন। মিন্টুকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা হলো তিনি আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের জন্য টাকা দিয়েছেন। মিন্টু বললেন, এর কিছুই তার জানা নেই। আরেকদিন বসুন্ধরার কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন তা প্রমাণের জন্য ওয়াকিল কমিশনারকে তার সামনে আনা হলো। ওয়াকিল বললেন, বসুন্ধরা নিয়মিত দলের জন্য তাকে টাকা দিতো। তিনি প্রতিবাদ করে বললেন ওয়াকিল একটা লায়ার। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পাঁচদিন রিমান্ডে তাকে দিয়ে তাদের মতো করে অনেক কথা বলাতে চেয়েছে। চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। করা হয়েছে অভদ্র আচরণ ও বিচিত্র প্রশ্ন। দেয়া হয়েছে নানা হুমকি। হাত বাঁধা চোখ বাঁধা অবস্থায় চলতো জিজ্ঞাসাবাদ। রিমান্ড শেষে তাকে কোর্টে নিয়ে যাওয়ার পর পাঠানো হয় জেলখানায়। কিন' জেলখানার বদলে তাকে হাসপাতালে রাখার নির্দেশ আসে। নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের প্রিজন সেলে। সেখানে প্রতিদিন রাত ২টার পর কর্নেল আফজাল ও কর্নেল সাঈদ আসতেন, সারারাত ঘুমাতে দিতেন না, মানসিক নির্যাতন করতেন। বলতেন নেত্রীর (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে তারা যা বলবেন তা লিখে দিতে হবে। নতুবা স্ত্রী-সন্তানদের টর্চার করবেন। তাকে জীবনভর জেলে আটকে রাখবেন। তিনি জেলের ভয়ে ভীত নন বললে বলতেন স্ত্রী-সনৱানদের তুলে নিয়ে যাবেন। পরে তারা তাদের মতো করে একটি লেখা নিয়ে আসেন। তিনি তাতে সই করে দেন স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। এরপর একদিন আফজাল ও সাঈদ বললেন, তাকে একদিনের জন্য ল্যাব এইডে যেতে হবে। তিনি জানতে চান কেন? তারা বললেন, নির্দেশ। তিনি ল্যাব এইডে যেতে রাজি না হলে আবারো নানা হুমকি দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তিনি ততকালীন ডিআইজির (প্রিজন) সঙ্গে কথা বলেন। তার কাছে জানতে চান বেআইনিভাবে তাকে ল্যাব এইডে নিতে চায় কেন? ডিআইজি তাদের কাছে হসৱানৱরের সরকারি কাগজপত্র চাইলে তাদের হুঁশ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা তার স্ত্রীর কাছে ছুটে যান। তাকে বলেন, উন্নত চিকিতসার জন্য তাকে ল্যাব এইডে নেয়া দরকার। এজন্য তার স্ত্রী যেন কর্তৃপৰের কাছে আবেদন জানান। সেনা কর্মকর্তারা তার স্ত্রীকে আইজি অফিসে নিয়ে যান। পরে তাকে ল্যাব এইডে নেয়ার পর রাত ১০টার দিকে বলা হয়, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি রাজি হননি প্রথমে। ডিআইজিকে বলেন, তিনি কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় কথা বলতে পারেন না। ডিআইজিকে চলে যেতে বললে তিনি বলেন, যাবেন কি করে। নিচে চারজন কর্নেল বসে আছেন। কথা না বলিয়ে তারা যাবেন না। এরপর তার সামনে নিয়ে আসা হয় সাংবাদিকদের। এটিএনের মুন্নী সাহা তাকে প্রশ্ন করেন, জলিল ভাই ভয় পেয়েছেন কি না। তিনি বলেন, মৃত্যুভয় কে না পায়। এরপর নানাভাবে তাকে দিয়ে ক্যামেরার সামনে নানা কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। পরদিন সকালে নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) গ্রেপ্তার করা হয়। আবদুল জলিলের কাছে জানতে চাওয়া হয়, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার বক্তব্য নিয়ে বাজারে আসা সিডি সম্পর্কে এবং তার স্ত্রী রেহানা জলিলের সংবাদ সম্মেলনে তার স্বাৰরিত চিঠি সম্পর্কে। জবাবে তিনি জানান, জোর করে মৃত্যুভয় দেখিয়ে স্ত্রী-সন্তান্দের জিম্মি করে কিছু সাজানো কথা তাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং সেনা সদস্যদের লেখা উদ্দেশ্যমূলক বেআইনি চিঠিতে তার স্বাৰর নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ওই সিডি সম্পর্কে যখন জিজ্ঞাসা করেন সেটি বাইরে গেল কীভাবে, তখন তাকে ডিজিএফআইর এক অফিসার জানালেন, একজন সাংবাদিক চুরি করে তা নিয়ে গেছেন। জিজ্ঞাসা করেন সাংবাদিক সংরৰিত এলাকায় এলেন কিভাবে? তখন জবাব পাওয়া যায়নি। আবদুল জলিল বলেন, নির্যাতনের মুখে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় কখন কি বলেছেন জানেন না। তবে জ্ঞানত চেষ্টা করেছেন দল ও নেত্রীর জন্য খতিকর হয়- এমন কোনো কথা না বলতে। এছাড়া স্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তার স্বাক্ষরিত যে চিঠি বিলি করা হয়েছে তা করেছে ডিজিএফআইর লোক। তাকে, তার পরিবারকে ও বাসার লোকজনকে জিম্মি করে তারা ওই কাজ করেছে বলে জানান তিনি। আবদুল জলিল বলেন, যারা রাজনীতিবিদদের এভাবে নির্যাতন করেছেন, তারা অ্যান্টি ডেমোক্রেটিক এবং অ্যান্টি লিবারেশন ফোর্স। ওই চক্র দেশে গণতন্ত্র নস্যাত করে সামরিকতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিলেন। জনগণের বাধার মুখে সফল হতে পারেননি। বর্তমান অবস্তার জন্য তার কোনো কষ্ট আছে কি না জানতে চাইলে আবদুল জলিল বলেন, এতো নির্যাতনের পরও বিনা কারণে আজকের এ অবস্থার জন্য মনের গহীনে চাপা কষ্ট থাকতেই পারে। কিন' জীবনে সব চাওয়া তো আর পাওয়া যায় না। তাই জীবনের শেষ প্রানেৱ এসে এসবকে তিনি তার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছেন।