হৃদয়ে একাত্তর-২ >> শহীদদের প্রকৃত তালিকা ও পরিচয় জানতে কোনো উদ্যোগ নেই

হৃদয়ে একাত্তর-২ >> শহীদদের প্রকৃত তালিকা ও পরিচয় জানতে কোনো উদ্যোগ নেই

কাজী সাইফুদ্দিন অভি : মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসরা নির্বিচারে নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে গণকবর দেয়। অনেকের লাশ জলাশয় বা গর্তে ফেলে রাখে। এক সময় এই লাশগুলো কঙ্কালে পরিণত হয়। তখন আর এগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় এসব হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শনাক্ত করতে না পারায় শহীদদের নাম-পরিচয় জানা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা কতো তা নির্ণয় করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলা হলেও সকল শহীদের নাম-পরিচয় জানার প্রয়োজন কেউ মনে করেনি। বেসরকারিভাবে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ শহীদদের ডিএনএ টেস্টের উদ্যোগ নিলেও সরকারি সহযোগিতার অভাবে সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা যায়, স্বাধীনতার পর প্রিয়জন হারানো অনেকেই পথ চেয়েছিলেন তাদের প্রিয় মানুষটি হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেননি। শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, কোনোভাবে যদি তারা জানতে পারেন বধ্যভূমিতে, গণকবরে পাওয়া মাথার খুলি, হাড় তাদের প্রিয়জনের তাহলে হয়তো তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন। শুধু তাই নয়, শহীদদের প্রকৃত তালিকা সংগ্রহেও এটি কার্যকর পদৰেপ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। শহীদদের স্বজনদের দাবি, স্বাধীনতার পর যে সব বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখান থেকে কঙ্কাল, মাথার খুলি, হাড়গোড় উদ্ধার করে তার ডিএনএ টেস্ট করে তাদের প্রিয়জনের লাশ শনাক্ত করা হোক। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে নিহতদের একজন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মাঝিগাতী ইউনিয়নের আবুতারা কাজী। রাজাকাররা তাকেসহ চার জনকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে পাক হানাদারদের কাছে দেয়। পরে হানাদাররা গোপালগঞ্জের তৎকালীন সিও অফিস সংলগ্ন ক্যাম্পের সামনে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেখানেই তাদের অর্ধমৃত অবস্থায় মাটিচাপা দেয়। তার ছেলে কাইয়ুম কাজী বলেন, আমার বাবা, দুই ফুফাতো ভাই ফারজু খাঁন ও কিবরিয়া খাঁনসহ চারজনকে একসঙ্গে পাক হানাদার ও রাজাকাররা হত্যা করে। আমার বাবাসহ যারা ওই সময় শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিচয়ের জন্য লাশ শনাক্ত করা উচিত। এটি করা হলে বাবার স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে পারবো। আমরা শুনেছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গণহত্যার পর ডিএনএ টেস্ট করে তাদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি তারা যেন এই উদ্যোগটি নিয়ে শহীদ পরিবারকে তাদের প্রিয়জনের স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেন। স্বাধীনতার পর বেসরকারিভাবে আবিষ্কৃত গণকবরগুলোতে শহীদদের সংখ্যা আজো বের করা সম্ভব হয়নি। এমনও হয়েছে কৃষক মাঠে লাঙল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে শহীদদের হাড়। আবার কোথাও একটু মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসছে শহীদের হাড়গোড়। কিন্তু এগুলো সংরৰণ ও তাদের নাম-পরিচয় জেনে স্মৃতিফলক নির্মাণ ও ডিএনএ টেস্ট করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে শহীদদের ডিএনএ টেস্ট করার উদ্যোগ নেয়া না হলেও বেসরকারিভাবে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এ উদ্যোগ নেয়। এজন্য তারা মিরপুর শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে পাওয়া শহীদদের হাড়গোড় ও মাথার খুলি সংগ্রহ করে তার ডিএনএ টেস্ট করার উদ্যোগ নেয়। ডিএনএ টেস্টের জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুলস্নাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার, শহীদ পুলিশ অফিসার জিয়াউল হক খান লোদীর মেয়ে জাহানারা খানের রক্ত ও শহীদ লে. সেলিমের পিতা ডা. এম এ সিকদারের দাঁতসহ মোট ৬ জনের পরিবারের সদস্যদের রক্তসহ বিভিন্ন নমুনা নেয়। এছাড়া চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কামানটিলায় শীলপাড়ার শহীদদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের নমুনাও ওই সময় সংগ্রহ করা হয়। শহীদদের ফরেনসিক ও ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৯৯ সালে মিরপুরের মুসলিম বাজার ও জলস্নাদখানা বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়ার পর আমরা সেখান থেকে এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কামানটিলা বধ্যভূমি থেকে শহীদদের ডিএনএ টেস্ট ও ফরেনসিক পরীৰার জন্য নমুনা সংগ্রহ করি। এরপর শহীদদের শরীরের বিভিন্ন অংশের ডিএনএ টেস্ট ও ফরেনসিক পরীৰা করতে নমুনা সংগ্রহ করে ভারতের সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে যাই। এই ল্যাবে পরীৰাও করা হয়েছিল। আমি আনঅফিসিয়ালি জানতে পেরেছিলাম পরীৰায় একটি রিপোর্ট পজেটিভ আসছিল। কিন্তু পরে আর অফিসিয়াল রিপোর্ট আমাদের দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে ফরেনসিক বিভাগে যোগাযোগ করলে তারা জানায় বাংলাদেশ সরকার অফিসিয়ালি রিপোর্ট না দেয়ার জন্য বলেছে। পরে আমি সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সেইভাবে সহযোগিতা পাইনি। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছে সরকারের ওপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ ছিল এই ধরনের রিপোর্ট না দিতে। তিনি বলেন, এরপরেও আমি বসে নেই। আমি লন্ডন, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। লন্ডনের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ভ্যানেজিসের সঙ্গে আমি ’৭১-এর শহীদদের ডিএনএ টেস্ট ও ফরেনসিক টেস্ট করার ব্যাপারে আলোচনা করেছি। তিনি আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন এটি করা সম্ভব। প্রতিটি কেসের জন্য ৭৫০ পাউন্ড করে খরচ হবে বলে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রমাণ হিসেবে ডিএনএ টেস্ট দালিলিক প্রমাণ হতে পারে। এখন আমাদের দেশেও ডিএনএ টেস্ট করা হচ্ছে। শুধু দরকার সরকারি উদ্যোগ। সরকার উদ্যোগ নিলে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গণকবর হিসেবে চিহ্নিত স্থানে শহীদদের পরিচয় বের করতে দুটি ধাপে কাজ করতে হবে। প্রথমে শহীদদের শরীরের যে সকল অংশ পাওয়া গেছে তার ফরেনসিক পরীৰা এবং ডিএনএ প্রোফাইলিং করা। এরপর যুদ্ধে যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন তাদের ডিএনএ প্রোফাইলিং করে মিলিয়ে দেখা। এভাবে শহীদদের পরিচয় জানা সম্ভব হতে পারে। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব (বর্তমানে ওএসডি) বীর মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ কিবরিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, শহীদদের সঠিক তালিকা ও নাম পরিচয় জানতে স্বাধীনতার পর পর কাজ শুরু করলে তা সহজ হতো। ৩৮ বছর পর শহীদদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারে এই গণকবরে তার স্বজনের লাশ আছে বা তাদের সংগ্রহে কোনো হাড়গোড় ও শরীরের অংশ থাকে তাহলে তার ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীৰা করা যেতে পারে। তবে এজন্য শহীদ পরিবার থেকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ প্রয়োজন হবে। শহীদ পরিবারের পৰ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ আমাদের কাছে দাবি জানালে আমরা বিষয়টি দেখবো।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা