জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি: ২৪ বছর পরও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিক্ষার্থীরা

জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি: ২৪ বছর পরও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিক্ষার্থীরা

ঢাকা, অক্টোবর ১৪ অক্টোবর এলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশির দশকের শিক্ষার্থীদের মনে একটি ট্রাজেডির স্মৃতি অনুরণিত হয়ে উঠে। বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর সেই ট্রাজেডির ২৪ তম বর্ষপূর্তি। ১৯৮৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সমপ্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক 'শুকতারা' দেখছিলেন কয়েক শ' শিক্ষার্র্থী। হঠাত করেই ধসে পড়ে টিভি রুমের ছাদ। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৩৮ শিক্ষার্থী। পরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০-এ। সেই থেকে দিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ট্রাজেডির ২৪ বছর পরও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বাধ্য হয়েই থাকছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এ যেন এক নতুন ট্র্যাজেডির নিরব অপেক্ষা। জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের একজন বিপুল কুমার সাহা। দুঃসহ সেইদিনটির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "সেদিন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি সিরিয়াল শুকতারা'র দ্বিতীয় পর্ব দেখতে আমরা প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী টিভি রুমে জড়ো হই। পুরো দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। "আমাদের ভবনটির অবস্থা এমনিতেই ছিল নাজুক। বৃষ্টি হলেই ছাদ বেয়ে পানি পড়তো। তাই ছাদে টিন দেওয়া ছিল। সকালে টিন সরিয়ে নেওয়ায় সারাদিনের বৃষ্টিতে ভবনটির ছাদ নরম হয়ে যায়। রাতে এটি ধসে পড়ে।" আরেক শিক্ষার্থী তাপস কুমার ঘোষ বললেন, "রুমের দুইপাশে যারা টিভি দেখতে বসেছিল, তাদের প্রায় সবাই ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।" "তবে সেদিনের সেই ঘটনার মাধ্যমে মৃত্যুর পূর্বে মরণ যন্ত্রণা বা এর ভয়াবহতা দেখার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল", বলেন তাপস। জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অজয় কুমার দাস বলেন, ধসে পড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯২১ সালে। ভেঙে পড়ার আগেই এটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। অথচ তখন এদিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং ছাদের উপর টিনের চালা বসিয়ে ছাদকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির ২৪ বছর পূর্ণ হলেও ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত এমন ভবন এখনো রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আমীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০০৪ সালে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটি জগন্নাথ হলের সন্তোস চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ভবনকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। পরে রোকেয়া হলের অনার্স বিল্ডিংকেও একই কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।" হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আক্কাস বলেন, ২০০৭ সালে হলের মূলভবনে ফাটল দেখা দেয়। এরপর সেই ভবন থেকে শিক্ষার্থীদেরকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীরা এখনো সেখানে থাকছে। এ অবস্থায় হলের মাঠে নির্মিত টিনশেডে আগামী ১ মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। জগন্নাথ হলের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অজয় কুমার দাস বলেন, হলের 'অক্টোবর স্মৃতি ভবন' ছাড়া প্রায় সব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ইস্ট বিল্ডিংয়ের অবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক। সামান্য ভূমিকম্প বা দুর্যোগে এটি দুলতে থাকে। তিনি বলেন, এ হলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সংখ্যালঘু ছাত্রদের হল। তাই এ হলে সবসময়ই শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ ছিল। আর তা মোকাবেলার জন্য স্বাধীনতার পর তড়িঘড়ি করে কারিগরি দিক পর্যালোচনা না করেই সন্তোস চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ভবন বা ইস্ট বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালের ভূমিকম্পে আহত জগন্নাথ হলের ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনের আবাসিক ছাত্র প্লাবন গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যেন ক্ষোভ ঝড়ে পড়লো। তার অভিযোগ অক্টোবর চলে গেলেই তাদের কথা সবাই ভুলে যায়। "অথচ যে কোন সময় আমরা চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি", বলেন এই শিক্ষার্থী। অপর এক শিক্ষার্থী সিদ্ধার্থ গোস্বামী বলেন, গত দুই বছরে পড়ো পড়ো এ ভবন থেকে গভীর রাতে ছয়-সাতবার বের হয়েছি। বের হতে গিয়ে কেউ কেউ আহতও হয়েছেন। অথচ এতো সবের পরও কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙেনি। ঝুঁকি নিরূপণে কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণেএকটি কমিটি করা হলেও চার-পাঁচ বছরেও সেই কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারেনি। কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, কমিটির যে কাজ করার কথা ছিল তা করা হয়নি। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভবন কতটা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, ২০০৩ সালের ২৭ জুলাই রাঙামাটির বরকলে ভূমিকম্পের প্রেক্ষিতে একই বছরের ৪ নভেম্বর ওই কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,
"১৫ অক্টোবরকে শোক দিবস হিসাবে পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ ও জমির অভাবে নতুন ভবন করতে না পারায় আমাদের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এখনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বাস করে, যা আরেকটি ট্র্যাজেডির জন্ম দিতে পারে।" শিগগিরই কয়েকটি হল নির্মাণ করা হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, "এখন নির্মাণাধীন ভবনগুলোর নির্মাণকাজও শেষের দিকে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে এসব সমস্যা থাকবে না।"

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day