বঙ্গবন্ধু মামলা: ঘটনাপঞ্জি
বঙ্গবন্ধু মামলা: ঘটনাপঞ্জি
"স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়।"
বঙ্গবন্ধু মামলার হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে যা আছে
ঢাকা, অক্টোবর ৫ স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারে হাইকোর্ট ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। খালাস দেয় তিন আসামিকে। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম এ রায় দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের সেই চূড়ান্ত রায়ে বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদা, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এস এইচ বি এম নূর চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. আজিজ পাশা, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদকে দেওয়া নিু আদালতের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন ও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারের ফাঁসির আদেশ বাতিল করে হাইকোর্ট। রায়ের শেষ অংশে হাইকোর্ট অভিমতে বলেছিল, ১২ সেনা কর্মকর্তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্মীকরণ করা হয়েছিল বলে সরকার পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছে। তারা হল, মেজর শরিফুল হক, মেজর আজিজ পাশা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন, মেজর বজলুল হুদা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন, মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন মাজেদ, লে. নাজমুল হোসেন আনসার, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও অপর একজন। অভিমতে বলা হয়, এই সাক্ষ্য প্রমাণ করে না যে, দণ্ডিত আসামিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পুরস্কার হিসেবে তা পেয়েছিলেন। কারণ, ওই সাক্ষ্য ঘটনার প্রায় এক বছর পরের। এর মধ্যে অপর তিনটি ঘটনা ঘটে গেছে। এর একটি জেলহত্যা, অপর দু'টি ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের ঘটনা। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই সুনির্দিষ্ট 'ইনফারেন্সে' আসা যায় না যে, সেই ঘটনার সকালে, এই আসামিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। অভিমতে আরও বলা হয়, সরকার পক্ষ এই আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিরা সেই সন্দেহের সুবিধা পাবে, যদি না সরকার পক্ষ অপর কোন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য দিয়ে সেই সন্দেহ দূর না করে। কিন্তু বর্তমান মামলায় সেই সন্দেহ দূর করার জন্য সরকার পক্ষ কোন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারেনি। রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের মূলনীতি হলো, আসামি দোষী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ ধরে নিতে হয়। অভিমতে আরও বলা হয়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার অপরাধ যদিও একটি বিদ্রোহ প্রকৃতির, তবু অপরাধের প্রকৃতি আবেগ দিয়ে প্রভাবিত নয়। আমরা কখনোই নিশ্চিতভাবে জানব না, দণ্ডিতরা ছাড়া আর কে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তাই এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ সতর্কতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। রায়ে বলা হয়, বর্তমান হত্যা ও ষড়যন্ত্রের এ মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। অভিযুক্তদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে বের করতে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হাইকোর্ট বলেছে, লে. কর্নেল ফারুক ও লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিবেচনার বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ, বিভক্ত রায়ে দুই বিচারপতি সেগুলো সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বলে একমত হতে পারেননি। তাই আমিও সেগুলো বিবেচনার বাইরে রাখছি। লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদের (আর্টিলারি) অপর একমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রমাণিত হয়েছে। তাই এই জবানবন্দি কেবল তার বিরুদ্ধে যাবে। তবে মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারকে জড়িয়ে তার এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিয়ে সমর্থিত না হওয়ায় এই তিন আসামির বিরুদ্ধে তা বিবেচনায় আনা হল না। এই একই বিবেচনায় ঢাকার দায়রা জজ আদালত এ মামলায় দফাদার মারফত আলী ও এলডি আবুল হোসেন মৃধাকে খালাস দিয়েছিল। সরকার পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারকে খালাস দেওয়া হল। তাদের মৃত্যুদন্ডের রায় বাতিল করা হল। লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনকে দায়রা আদালত সঠিকভাবেই মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছেন। তাদের ক্ষেত্রে ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করা হল। লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) আপিল খারিজ করা হল। হাইকোর্ট এর আগে ২০০০ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিভক্ত রায় দিয়েছিল। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন নিু আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে পাঁচজনকে খালাস দিয়েছিলো। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখেন। বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি হিসেবে চূড়ান্ত রায় দেন।
"স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়।"
এ ঘটনার দীর্ঘ ২১ বছর পর দায়ের করা হয় মামলা।
১৯৯৮ সালে বিচারিক আদালত ১৫ আসামির ফাঁসির রায় দেয়। হাইকোর্টের চূড়ান্ত বিচার শেষে বর্তমানে আপিলটি আপিল বিভাগে চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঘটনাক্রম:
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দু'কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫: এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে।
১২ নভেম্বর, ১৯৯৬: আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে।
২ অক্টোবর, ১৯৯৬: হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৪ আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
১৫ জানুয়ারি, ১৯৯৭: তদন্ত শেষে পুলিশ ২৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
১২ মার্চ, ১৯৯৭: চার আসামি মারা যাওয়ায় ২০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু।
৭ এপ্রিল, ১৯৯৭: একই আদালত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।
৮ নভেম্বর, ১৯৯৮: দেড়শ' কার্য দিবস শুনানির পর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ওই রায়ের পর এর বিরুদ্ধে কারাবন্দি চার আসামি অবসরপ্রাপ্ত মেজর (অব) বজলুল হুদা, বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ হাইকোর্টে আপিল করে।
২৮ জুন, ২০০০: হাইকোর্টের বিচারপতিরা কয়েক দফা বিব্রত হওয়ার পরে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু।
১৪ ডিসেম্বর, ২০০০: ৬৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন।
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০১: হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের আদালতে মামলার শুনানি শুরু।
৩০ এপ্রিল, ২০০১: তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়। চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামির মধ্যে পরে ওই বছরই কারাবন্দি চার আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে।
১৩ র্মাচ, ২০০৭: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার।
১৮ জুন, ২০০৭: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামী ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
২৪ জুন ২০০৮: ল্যান্সার মহিউদ্দিনের জেল আপিল।
২ আগস্ট, ২০০৭: হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের দায়ের করা লিভ টু আপিলের ওপর শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন।
৭ আগস্ট ২০০৭: বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম, বিচারপতি জয়নাল আবেদীন ও বিচারপতি মো. হাসান আমিনের আপিল বিভাগের বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ শুরু করে।
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭: আপিল বিভাগ ২৫ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ (লিভ মঞ্জুর) করে।
৩০ অক্টোবর, ২০০৭: পেপারবুক তৈরি করে জমা দিতে আসামী পক্ষের শেষ সময়। তারা পেপারবুক ও যুক্তির সংক্ষিপ্তসার আদালতে জমা দেয়।
২৩ আগস্ট, ২০০৭: রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তির সংক্ষিপ্তসার আপিল বিভাগে জমা দেওয়া হয়।
২৪ আগস্ট, ২০০৭: আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য ৫ অক্টোবর তারিখ ধার্য করে দেন।
৪ অক্টোবর, ২০০৭: মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠন।
বঙ্গবন্ধু মামলার হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে যা আছে
ঢাকা, অক্টোবর ৫ স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারে হাইকোর্ট ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। খালাস দেয় তিন আসামিকে। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম এ রায় দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের সেই চূড়ান্ত রায়ে বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদা, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এস এইচ বি এম নূর চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. আজিজ পাশা, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদকে দেওয়া নিু আদালতের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন ও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারের ফাঁসির আদেশ বাতিল করে হাইকোর্ট। রায়ের শেষ অংশে হাইকোর্ট অভিমতে বলেছিল, ১২ সেনা কর্মকর্তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্মীকরণ করা হয়েছিল বলে সরকার পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছে। তারা হল, মেজর শরিফুল হক, মেজর আজিজ পাশা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন, মেজর বজলুল হুদা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন, মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন মাজেদ, লে. নাজমুল হোসেন আনসার, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও অপর একজন। অভিমতে বলা হয়, এই সাক্ষ্য প্রমাণ করে না যে, দণ্ডিত আসামিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পুরস্কার হিসেবে তা পেয়েছিলেন। কারণ, ওই সাক্ষ্য ঘটনার প্রায় এক বছর পরের। এর মধ্যে অপর তিনটি ঘটনা ঘটে গেছে। এর একটি জেলহত্যা, অপর দু'টি ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের ঘটনা। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই সুনির্দিষ্ট 'ইনফারেন্সে' আসা যায় না যে, সেই ঘটনার সকালে, এই আসামিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। অভিমতে আরও বলা হয়, সরকার পক্ষ এই আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিরা সেই সন্দেহের সুবিধা পাবে, যদি না সরকার পক্ষ অপর কোন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য দিয়ে সেই সন্দেহ দূর না করে। কিন্তু বর্তমান মামলায় সেই সন্দেহ দূর করার জন্য সরকার পক্ষ কোন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারেনি। রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের মূলনীতি হলো, আসামি দোষী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ ধরে নিতে হয়। অভিমতে আরও বলা হয়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার অপরাধ যদিও একটি বিদ্রোহ প্রকৃতির, তবু অপরাধের প্রকৃতি আবেগ দিয়ে প্রভাবিত নয়। আমরা কখনোই নিশ্চিতভাবে জানব না, দণ্ডিতরা ছাড়া আর কে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তাই এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ সতর্কতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। রায়ে বলা হয়, বর্তমান হত্যা ও ষড়যন্ত্রের এ মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। অভিযুক্তদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে বের করতে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হাইকোর্ট বলেছে, লে. কর্নেল ফারুক ও লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিবেচনার বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ, বিভক্ত রায়ে দুই বিচারপতি সেগুলো সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বলে একমত হতে পারেননি। তাই আমিও সেগুলো বিবেচনার বাইরে রাখছি। লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদের (আর্টিলারি) অপর একমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রমাণিত হয়েছে। তাই এই জবানবন্দি কেবল তার বিরুদ্ধে যাবে। তবে মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারকে জড়িয়ে তার এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিয়ে সমর্থিত না হওয়ায় এই তিন আসামির বিরুদ্ধে তা বিবেচনায় আনা হল না। এই একই বিবেচনায় ঢাকার দায়রা জজ আদালত এ মামলায় দফাদার মারফত আলী ও এলডি আবুল হোসেন মৃধাকে খালাস দিয়েছিল। সরকার পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারকে খালাস দেওয়া হল। তাদের মৃত্যুদন্ডের রায় বাতিল করা হল। লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনকে দায়রা আদালত সঠিকভাবেই মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছেন। তাদের ক্ষেত্রে ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করা হল। লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) আপিল খারিজ করা হল। হাইকোর্ট এর আগে ২০০০ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিভক্ত রায় দিয়েছিল। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন নিু আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে পাঁচজনকে খালাস দিয়েছিলো। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখেন। বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি হিসেবে চূড়ান্ত রায় দেন।