জামায়াত সমর্থক গোলাম মাওলাই বাংলাদেশে হিযবুতের প্রতিষ্ঠাতা
জামায়াত সমর্থক গোলাম মাওলাই বাংলাদেশে হিযবুতের প্রতিষ্ঠাতা
আসাদ রেহমান, ঢাকা থেকে
বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা আগে ছিলেন জামায়াত সমর্থক। সেই সূত্র ধরে এখনও রয়েছে তার জামায়াত কানেকশন। এদিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশে হিযবুতের নীতিনির্ধারক নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহরীরের জন্ম আরবের মাটিতে হলেও সেখানকার প্রতিটি দেশেই সংগঠনটি নিষিদ্ধ। ১৯৫৩ সালে ফিলিস্তিনি আলেম শায়খ তাকীউদ্দীন আন্ নাবাহানী এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আরব বিশ্বের সীমান্ত পেরিয়ে অনারব ও অমুসলিম দেশেও সংগঠনটি বিস্তৃতি লাভ করে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যেও সংগঠনটির শাখা রয়েছে। যুক্তরাজ্য শাখার হাত ধরেই বাংলাদেশে এ দলটি প্রতিষ্ঠা পায়। নব্বয়ের দশকের শুরুতে যুক্তরাজ্য ফেরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম মাওলাই হচ্ছেন হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা। হিযবুত তাহরীর প্রতিষ্ঠার আগে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিলেন। তবে প্রতিষ্ঠাতা গোলাম মাওলা দলটির কোন পদে নেই, দলটির নেই কোন পূর্ণাঙ্গ কমিটি। জন্ম থেকেই হিযবুত তাহরীর সমন্বয় কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশ শাখার প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মহিউদ্দীন আহমেদ। শুরুতে এলিফ্যান্ট রোড থেকে সংগঠনের কর্মকা- পরিচালিত হলেও বর্তমানে ৫৫/এ, পুরানা পল্টন থেকে দলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০০১ সালে দলটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। গোয়েন্দা তথ্য মতে, দলটি ইতোমধ্যেই দু’হাজার নিবেদিত কর্মী ও ১ লাখের বেশি সমর্থক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। উগ্র মতবাদ প্রচারের জন্য দলটির প্রতিষ্ঠাতা গোলাম মাওলাসহ ১শ’র বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় তারা গ্রেফতার হলেও বর্তমানে বেশিরভাগই জামিনে রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম মাওলা রাজশাহী থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিযবুত তাহরীরের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা রয়েছে। আর কারাবন্দি আছে ৮ নেতাকর্মী। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হিযবুত তাহরীরের কোন প্রচারণাপত্রে দলটির কোন দেশে নিষিদ্ধ কথা উল্লেখ না থাকলেও দলটি যে বিভিন্ন দেশে তৎপর এবং রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত তার কথা উল্লেখ করা হয় ভ্রান্তভাবে। যার মধ্য দিয়ে হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাদের দলের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে ব্যর্থ হয় । যেমন হিযবুত তাহরীরের প্রচারণাপত্রে বলা হয়েছে ঃ ’স্বীয় চিন্তার ক্ষেত্রে সৎ, স্বচ্ছ ও খোলামেলা। তাই এই দল ভুল মতাদশের্র ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য ব্যক্তি ও দলের চিন্তাকে প্রশস্ত করা, কাফির সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং জনগণের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মোকবেলার জন্য প্রকাশ্যে শাসক গোষ্টীকে চ্যালেঞ্জ করা ইত্যাদি কাজে কোনরূপ নমনীয়তা, অবহেলা কিংবা আপসকামিতার নীতি অনুসরণ করে না। এ ব্যাপারে হিযবুত তাহরীর কারও মুখরক্ষার নীতি অবলম্বন করে না কিংবা বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিণতির আশঙ্কা করে সত্য প্রকাশ থেকেও বিরত হয় না। মোট কথা এ দল এমন প্রত্যেক বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করে, যা ইসলামী নিয়ম-নীতির খেলাফ। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের সরকার দীর্ঘদিন ধরে হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, চলাফেরায় কড়াকড়ি আরোপ, দেশ থেকে বহিষকার, মালামাল ক্রোক, জীবনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা, ভ্রমণে বাধা দান এমনকি হত্যা করার মতো কঠিন নিপীড়ন ও শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে। ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়াসহ বহু মুসলিম দেশের জালিম শাসকরা হিযবুত তাহ্রীরের শত শত সদস্যকে হত্যা করেছে। এমনিভাবে জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, লিবিয়া, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তিওনিসিয়াসহ অনেক দেশের জেলগুলোতে হিযবুত তাহ্রীরের হাজার হাজার সদস্য বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।’কী চায় হিযবুত তাহরীর ঃ হিযবুত তাহরীরের ভাষ্য মতে, দলটি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। খিলাফতের সংজ্ঞায় দলটি বলে ’ইসলামী শাসন তথা খিলাফত ব্যবস্থা হচ্ছে একক ব্যবস্থা। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় নেতৃত্ব ও প্রশাসন থাকবে একটাই। বিষয়টি এমন নয় যে, বিভিন্ন দেশের সরকার একত্র হয়ে একটি ঐক্য বা ফেডারেল সরকার গঠন করবে। কারণ মুসলমানদের জন্য একই সময়ে একাধিক ইসলামী সরকার থাকা জায়েয নেই। হিযবুত তাহ্রীর তার চিন্তা, মতামত ও নিয়মনীতির বিকাশ ঘটাতে এ পর্যন্ত ২৪টি বই প্রকাশ করেছে। এগুলো হলো ঃ ইসলামী জীবন বিধান, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা, দল গঠনের প্রক্রিয়া, হিযবুত তাহ্রীরের চিন্তাসমূহ, ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী ব্যক্তিত্ব (তিন খ-ে), হিযবুত তাহ্রীরের রাজনৈতিক ধারণাসমূহ, হিযবুত তাহ্রীরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংবিধানের ভূমিকা, খিলাফত, কিভাবে খিলাফতকে ধ্বংস করা হলো, ইসলামী দ-বিধি, ইসলামে সাক্ষ্যের বিধি-বিধান, মার্কসীয় কমিউনিজমের জবাব, চিন্তা, মনের অবস্থান, ইসলামী চিন্তা, পশ্চিমা পুঁজিবাদী তত্ত্ব-’থিওরী অব লায়াবিলিটি’র জবাব, উষ্ণ আহ্বান, আদর্শ অর্থনৈতিক নীতি, বাইতুল মাল ও ইসলামী নাফসিয়্যা’র অতি প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ। দেশের অন্যান্য প্রকাশ্য ইসলামী দলগুলোর মতো এ দলটি প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির প্রতি বিশ্বাস রাখে না। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী এর ব্যখ্যা করেন এভাবে ঃ ’আমরা প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা সমর্থন করি না। কারণ, এর মাধ্যমে শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। কিন্তু সরকার ব্যবস্থা বা আদর্শিক কোন পরিবর্তন হয় না। এ কারণে জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে হবে।’ দলটি সশস্ত্র জিহাদেও বিশ্বাস করে। তবে তাদের জিহাদের ভাষা আল-কায়দা, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানদের মতো নয়। জিহাদের কথা বলার সময় তারা যথেষ্ট কৌশলী। হিযবুত তাহরীরের প্রচারণামূলক বইয়ে জিহাদের কথা বলা হয়েছে এভাবে ঃ ’হিযবুত তাহ্রীরের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফের ইসলামী জীবন পদ্ধতিকে ফিরিয়ে আনা এবং সমগ্র বিশ্বে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দেয়া। হিযবুত তাহরীর মনে করে বর্তমান বিশ্বে তিন ধরনের মতাদর্শ বিদ্যমান আছে। ১. ইসলাম, ২. গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও ৩. সমাজতন্ত্র। ইসলাম ঃ যে সরকার আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান তথা কোরান ও সুন্নাহ্িভত্তিক আহকাম দ্বারা শাসন করে তাকেই শুধু বলা যাবে ইসলামী সরকার বা কর্তৃপক্ষ। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ঃ এটি পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিনিদের মতবাদ। এই মতবাদ ধর্মকে রাষ্ট্র এবং জীবন থেকে আলাদা রাখার মূল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজতন্ত্র ঃ সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিজম হচ্ছে একটি বস্তুবাদী মতবাদ। যা বস্তু ছাড়া সব কিছুকেই অস্বীকার করে। এই মতবাদের দাবি হলো বস্তুই জগতের মূল উৎস; বস্তুর কোন আদি অন্ত নেই; এই বস্তু কোন স্রষ্টার সৃষ্টি নয় এবং সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছুই নেই; এমনিভাবে কেয়ামত দিবসেরও কোন বাস্তবতা নেই। এই মতবাদ ধর্মকে জনগণ ও জাতির জন্য আফিমের মতো ক্ষতিকর মনে করেহিযবুত তাহরীরের কর্মকান্ড ৩টি পর্যায়ে বিভক্ত ঃ ১ম পর্যায় ঃ দল গঠনের পর্যায় ঃ এ দলের চিন্তা ও পদ্ধতিতে আস্থাশীল ব্যক্তিদের গঠনমূলক প্রক্রিয়ায় এমনভাবে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, যেন এর মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল দল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। ২য় পর্যায় ঃ গণআন্দোলন সৃষ্টির পর্যায় ঃ যেন এর মাধ্যমে উমমাহ্ ইসলামের পতাকাধারী রূপে তৈরি হয় এবং এ কাজকে নিজেদের ওপর অর্পিত ফরজ দায়িত্ব বলে মনে করে। আর নিজেদের বাস্তব জীবনে ইসলামী বিধি-বিধান কার্যকর করার তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ৩য় পর্যায় ঃ শাসন কর্তৃত্ব লাভের মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করা এবং বিশ্বব্যাপী এর দাওয়াত পৌঁছানোর পর্যায়।