ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু
তোফায়েল আহমেদ
প্রতি বছর ২৩ ফেব্র"য়ারি দিনটি আমি গভীরভাবে স্মরণ করি। এ দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্র"য়ারি ইতিহাসের মহামানব, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। প্রিয় নেতা তার যৌবনের চৌদ্দটি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার ছবি হূদয় দিয়ে এঁকেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেই নেতাকেই সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। তিনি শুধু বাঙালি জাতিরই মহান নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। পাকিস-ান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এ পাকিস-ান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাঙালিকে বাংলার ভাগ্যনিয়ন-া হতে হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬৮-৬৯ এক গৗরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ ওই কালপর্বটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল।’ বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে তাদের ফাঁসি দিয়ে নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস-ার করে আইয়ুব খান এগো"িছল। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুর" হয় তখন আমরা উপলব্ধি করি, বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় তাহলে চিরদিনের জন্য বাঙালি জাতির কণ্ঠ স-ব্ধ হয়ে যাবে। তাই আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি ১১ দফা কর্মসূচি জাতির সামনে পেশ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপসি'তিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করা হয়। ৮ জানুয়ারি সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৮টি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ দফাভিত্তিক এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি দেশের ৮টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ভিত্তিতে উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃবব সংক্ষেপে ‘ডাক’ গঠন করে। ১২ জানুয়ারি ডাক প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৮ দফা দাবির ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি ‘দাবি দিবস’ পালনের সিদ্ধান- গৃহীত হয়। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ডাক-এর আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। সেদিনের ব্যাপক পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি শনিবার ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উ"চারণ- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ সন্ধ্যায় জিন্নাহ হলে (বর্তমানে সূর্যসেন হল) ইপিআর কর্তৃক ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ। ১৯ জানুয়ারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, পুলিশের বাধা ও গুলিবর্ষণ। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক। এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু হয়। শহীদ মিনারের সামনে অনুষ্ঠিত শোকসভায় আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা শপথ গ্রহণ করি। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের গায়েবানা জানাজা শেষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন; ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল; ২৪ জানুয়ারি বেলা ২টা পর্যন- হরতাল।
১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জানাজার পরে লাখো মানুষের মিছিল। ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা আর প্রতিটি মানুষের বুকে কালো ব্যাজ। ২৩ জানুয়ারি ঢাকা শহর মশাল আর মিছিলের নগরী। ইতিহাসের বৃহত্তম মশাল মিছিল। ২৪ জানুয়ারি হরতাল। ছাত্র-গণমিছিলে গুলিতে ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমানের মৃত্যু। ‘দৈনিক পাকিস-ান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিসে আগুন। শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় আনোয়ার, র"স-ম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। দুপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। আমার বক্তৃতার পর সেখান থেকে মিছিল জমায়েত হয় ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুর"ল হক হল) মাঠে। সান্ধ্য আইন অমান্য করে রাজপথে লাখো মানুষের ঢল নামে। গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস-ানে গণবিক্ষোভ। ১ ফেব্র"য়ারি আইয়ুব খানের বেতার ভাষণ। বিরোধী দল এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রত্যাখ্যান। ৬ ফেব্র"য়ারি আইয়ুবের পূর্ব পাকিস-ান সফর। সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান- ঘোষণা।
৮ ফেব্র"য়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ওপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
৯ ফেব্র"য়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পল্টন ময়দানে ‘শপথ দিবস’ পালন। পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র হিসেবে আমার সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে ১০ জন ছাত্রনেতা জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প ঘোষণা করেন এবং শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি না হওয়া পর্যন- আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ গ্রহণ করেন। এই দিন স্লোগান ওঠে ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করবো।’
১১ ফেব্র"য়ারি পাকিস-ান প্রতিরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দিদের বিনাশর্তে মুক্তি লাভ। ১২ ফেব্র"য়ারি পূর্ব পাকিস-ান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তি লাভ।
১৪ ফেব্র"য়ারি ‘ডাক’-এর সারা দেশে হরতাল আহ্বান। পল্টনের সভায় জনতা কর্তৃক নুর"ল আমিন ও ফরিদ আহমদ লাঞ্ছিত।
১৫ ফেব্র"য়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুর"ল হককে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন-রে নির্মমভাবে হত্যা।
১৫ থেকে ২০ ফেব্র"য়ারি পর্যন- সান্ধ্য আইন জারি। আইয়ুব খানের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার এবং প্যারোলে মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিবসহ বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ। ছাত্র-জনতা কর্তৃক প্যারোলে মুক্তির প্রস-াব প্রত্যাখ্যান।
১৬ ফেব্র"য়ারি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ঢাকা। বাংলা একাডেমী সংলগ্ন স্টেট হাউসে অগ্নিসংযোগ। পল্টনে লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণে সার্জেন্ট জহুর"ল হকের গায়েবানা জানাজা।
১৭ ফেব্র"য়ারি সারাদেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন।
১৮ ফেব্র"য়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাকিস-ানি সেনাদের বেয়োনেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা।
২০ ফেব্র"য়ারি বিকাল ৫টায় সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার।
২১ ফেব্র"য়ারি শহীদ দিবসে আমার সভাপতিত্বে পল্টনের মহাসমুদ্রে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের অগ্রনায়কদের সংগ্রামী শপথ এবং শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্র"য়ারি আইয়ুব শাহী সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।বস'ত,
১৯৬৬-এর ৮ মে’র গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্র"য়ারি যে মুজিব মুক্তি লাভ করেন- নাম বিচারে এক হলেও, বাস-বে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্ত মানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ তারিখ আমরা ইকবাল হলের প্রভোস্টের কক্ষে সারা রাত সভা করি। অনেক প্রস-াব এসেছিল গণসংবর্ধনার- মওলানা ভাসানী, মনি সিংহ, জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদেরও অভ্যর্থনা দেয়ার প্রেসার এসেছিল। কিন' আলোচনা করে সিদ্ধান- নেই, আমরা একজনকেই সংবর্ধনা জানাব। তিনি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। সেই অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্র"য়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জনসভার আয়োজন করা হয়।শুর"তেই বলেছি এদিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান- থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। এর আগে এত বড় জনসভা আমি দেখিনি। এটা জনসভা ছিল না, ছিল জনসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে এক নজর দেখতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। তখন একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, আমি প্রত্যেকটি সভার সভাপতিত্ব করতাম এবং সভা পরিচালনা করতাম। কে বক্তৃতা করবে সেই নামটিও আমিই ঘোষণা করতাম। সেদিন ওই মঞ্চে ৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছিলেন। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘সবার শেষে আমার বক্তৃতা করার কথা থাকলেও আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আগেই বক্তৃতা করতে চাই।’ দশ লাখ লোক আমাকে সম্মতি জানাল। বঙ্গবন্ধুর আগেই বক্তৃতা দিলাম। আমার জীবনে এই বক্তৃতাটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। সেদিন কী ভালোবাসা যে আমি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। বক্তৃতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।’ আমি যখন ১০ লাখ লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রিয় নেতাকে আজ আমরা একটা উপাধি দিতে চাই।’ তখন ১০ লাখ লোক হাত তুলে আমাকে সম্মতি জানিয়েছিল। আর তখনই আমি ঘোষণা করেছিলাম, ‘যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস-ানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করতে চাই।’ ১০ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সেদিন এ প্রস-াব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’এমন একটি মধুর দিন আমার জীবনে আর কোনদিন আসবে না। বছর ঘুরে দিনটি যখন ফিরে আসে হূদয়ের মানসপটে কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। এদিনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। সেদিন বক্তৃতায় আমি আরও বলেছিলাম, ‘৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচি বাস-বায়নে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা ফিরে পেয়েছি। তাদের সে রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এ আন্দোলন শুর" হয়েছে। প্রিয়নেতা, মানুষ তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যদি এই বিশ্বাসের বরখেলাপ করো, তবে বাংলার মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না।’ বক্তৃতা শেষ করে ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বললেন, ‘রাতের অন্ধকারে সান্ধ্য আইনের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে যে মানুষ ‘মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে’ বলে আওয়াজ তুলে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তাদের দাবির সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’
সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থনই করি না, এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরণে রাজি আছি। ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আমার ৬ দফা দাবিও নিহিত রয়েছে। আপনারা নিশ্চিন- থাকুন। আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব।’ উত্তাল গণআন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘আমি তাদের নেতা মেনে নিয়েছি। তারা যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার তুলনা নেই।’ সর্বজনপ্রিয় দাবি ‘এক মাথা এক ভোট’-এর ভিত্তিতে নির্বাচন ও পার্লামেন্ট প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি সংখ্যা সাম্য মানি না।
কোনমতেই আমার দল সংখ্যা সাম্য মেনে নেবে না। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন পার্লামেন্ট গঠন করতে হবে। বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল করা হবে, না তা সংশোধন করা হবে, নির্বাচিত পার্লামেন্টই তা নির্ধারণ করবে। সংখ্যা সাম্য যারা মানবে বাংলার মাটিতে তাদের ঠাঁই নাই। সংখ্যা সাম্যের নামে এতকাল বাঙালিকে ঠকানো হয়েছে। সর্বস-রে এবং সর্বপর্যায়ে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব চাই।’ গোলটেবিলে জনগণের দাবি আদায় প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি রাওয়ালপিণ্ডি যাব এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস-ানের জনগণের পক্ষ হতে তাদের দাবি তুলে ধরব। দেশ আমরা কারও কাছে বিকিয়ে দেইনি। আমার ৬ দফার সঙ্গে জনগণ আছে।’ দেশরক্ষা খাতের ব্যয় বৈষম্য সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘এই খাতের শতকরা ৮০ ভাগ অর্থই পশ্চিম পাকিস-ানে ব্যয় হয়। কারণ সামরিক সদর দফতর সেখানে অবসি'ত।’ পাকিস-ানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে চাকরি বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রাজধানী পশ্চিম পাকিস-ানে অবসি'ত। ফলে সেখানকার লোক সব রকম সুবিধা পা"েছ।
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন চাকরিতে বাঙালিদের সংখ্যা শতকরা ১০ জনেরও কম। কেন্দ্রীয় সরকারের সব অফিস-আদালত শুধু রাজধানীতে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যও সেখানে নিয়ন্ত্রিত হ"েছ। ফলে বাংলায় মূলধন গড়ে উঠছে না।’ রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধের সরকারের ঘৃণ্য সিদ্ধানে-র বির"দ্ধে বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়র, অ্যারিস্টটল, দানে-, লেনিন, মাওসেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য আর দেউলিয়া সরকার রবীন্দ্রনাথের লেখা নিষিদ্ধ করেছে। রবীন্দ নাথ বাঙালি কবি। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে তিনি বিশ্বকবি হয়েছেন।’ তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা সরকারের এই সিদ্ধান- মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বোই, রবীন্দ্র সঙ্গীত এদেশে গীত হবেই হবে।’ ক্যান্টনমেন্টে দুঃসহ কারাজীবনের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত স্বরে বলেন, ‘আমরা সবাই ফিরে এসেছি। কিন' সার্জেন্ট জহুর"ল হককে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারিনি। তার ভাইয়ের বাসায় যখন দেখা করতে গিয়েছি তারা বলেছে, ‘আমাদের কোন দুঃখ নেই। আপনি ফিরে এসেছেন আপনিই আমাদের বড় ভাই।’ পরিশেষে তিনি স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞস্বরে বলেন, ‘ভায়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’ কী বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। অবাক লাগে আজ ভাবতে, তিনি একা রক্ত দিয়ে যান নাই- ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্র"য়ারি একটি ঐতিহাসিক গুর"ত্বপূর্ণ দিন। যতদিন বেঁচে থাকব হূদয়ের গভীরে লালিত এ দিবসটিকে স্মরণ করব।
তোফায়েল আহমেদ
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য; সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান- সংসদীয় স্থায়ী কমিটি