তাঁর নামের সঙ্গে বিশেষণের দরকার নেই



তাঁর নামের সঙ্গে বিশেষণের দরকার নেই
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ॥ আবদুর রাজ্জাক চলে গেলেন (ইন্নালিলস্নাহি...রাজিউন)। লন্ডনের একটি নয় দুটি হাসপাতালে দীর্ঘ কয়েক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘকাল লিভারের জটিল অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর দেহে নতুন লিভার সংযোজন জরুরী হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি লিভারের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু সেটি সুস্থ লিভার নয়। চিকিৎসায় অর্থাভাবও ছিল। সেই অর্থের সংস্থান হলো। কিন্তু নতুন লিভার সংস্থাপনের মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর ছিল না। ডাক্তাররা তাঁর দেহে অস্ত্রোপচারের জন্য সময় নিচ্ছিলেন। তাঁর পর তো দেখা গেল, যার কাছ থেকে লিভার পাওয়া নিশ্চিত ছিল তিনি নিজেই অসুস্থ।
একটি লিভারের অভাবে আবদুর রাজ্জাককে বাঁচানো যাবে না, এটা তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। চিকিৎসকরাও বলছিলেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা অপারেশন সহ্য করার মতো সবল হয়ে ওঠেনি। তাঁকে শেষ পর্যনত্ম লাইফ সাপোর্ট মেশিনে রাখা হয়েছিল। যখন দেখা গেল তাঁর জীবন রৰার আর কোন উপায় নেই, তখন আজ (২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার) তাঁর শরীর থেকে লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে নেয়া হয়। দুপুরের পরই সারা লন্ডন শহরে খবর প্রচারিত হয় আব্দুর রাজ্জাক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে যখন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, তখনই দেখেছি রোগশয্যায় একটি কঙ্কাল পড়ে আছে। আমার দীর্ঘকালের চেনা আব্দুর রাজ্জাক আর নেই। আমাকে যখন চিনলেন, তখন তাঁর চোখে পানি। তাঁকে দেখাশোনা করছেন এমন এক যুবকের মুখে শুনলাম, রাজ্জাক আমলকী খেতে চান। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়েছিল।
সত্তর বছর বয়সের মৃত্যুকে অকাল মৃত্যুই বলব। বাংলাদেশের রাজনীতির এই ঘনঘটার দিনে আবদুর রাজ্জাকের বড় প্রয়োজন ছিল। গণতান্ত্রিক শিবিরের আগামী দিনের আরও জটিল সংগ্রামে আবদুর রাজ্জাক থাকবেন না_ এটা ভাবতেও শঙ্কা হয়। স্বাধীনতার শত্রম্নপৰের শিবির তো শূন্য হচ্ছে না। শূন্য হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের শিবির। এই শূন্যতা পূরণ করবে কারা? পূরণ হবে কিভাবে?
বঙ্গবন্ধুর দুই বিশ্বস্ত যুববাহুর মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক এবং আরেকজন তোফায়েল আহমেদ। তাদের দু'জনের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে ছিল একই রাজনৈতিক লৰ্যের গভীর মৈত্রী দু'জনের মধ্যে। আবদুর রাজ্জাকের শরীরে লিভার সংস্থাপনের দিনৰণ যখন চিকিৎসকরা ঠিক করেছিলেন, তখন তোফায়েল দু'দুবার ঢাকা থেকে লন্ডনে ছুটে এসেছেন, আর রাজ্জাক ভাইয়ের জীবন- মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাঁর পাশে থাকার জন্য। কিন্তু রাজ্জাকের শারীরিক অবস্থার জন্য ও লিভারের অভাবে অস্ত্রোপচার দুই দুইবার স্থগিত করতে হয়েছে।
গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবদুর রাজ্জাক একটি নাম, যে নামের কোন পরিচয়, কোন বিশেষণের দরকার নেই। আবদুর রাজ্জাক নিজেই বলতেন, 'আমি বঙ্গবন্ধুর একজন শিষ্য, এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।' বঙ্গবন্ধু তাঁকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, বাকশাল গঠনের পর সংগঠনের তিন সেক্রেটারির অন্যতম সেক্রেটারি তাঁকে করেছিলেন। আর দু'জন ছিলেন জিল্লুর রহমান (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) এবং শেখ ফজলুল হক মণি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগেরও প্রধানের পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদের পর আওয়ামী লীগ সংগঠনের ভিত্তি ধ্বংস হতে না দেয়া, শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণে টেনে আনা থেকে শুরু করে ঘাতক দালাল নিমর্ূল আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান, সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব গ্রহণ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পৰের শিবিরে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন একজন সর্বৰণিক সেনাপতি। প্রথম হাসিনা সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ ও গঙ্গার পানির হিস্যা লাভের চুক্তি সম্পাদনেও তাঁর ছিল সফল ভূমিকা।
আজ শুক্রবার তাঁর মৃতদেহ আমার বাসার অদূরে লন্ডনের এক হাসপাতালে যখন কফিনে তোলার জন্য প্রস্তুতি চলছে, তখন স্মৃতিচারণ করার মতো মনমানসিকতা কোনটাই আমার নেই। তিনি ছিলেন আমার ছোট ভাই এবং দীর্ঘকালের বন্ধু। লন্ডনে এলেই আমার সঙ্গে দেখা করতেন। ঢাকায় গেলেও আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে আসতেন। তাঁকে হারানোর বেদনা আত্মীয় বিয়োগব্যথার চাইতেও বেশি। মনমানসিকতা একটু স্বাভাবিক হলে তাঁর সম্পর্কে একটি দীর্ঘ স্মৃতিকথা লেখার ইচ্ছা রাখি। এই মুহূর্তে তাঁর শোকসনত্মপ্ত স্ত্রী ও পরিবার পরিজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই এবং প্রার্থনা করি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আবদুর রাজ্জাক যেন মৃত্যুর পরেও অনন্ত শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন।
[লন্ডন, ২৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২০১১

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day