*ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও জিয়া পরিবারের গন্তব্য কোথায়...?

*ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও জিয়া পরিবারের গন্তব্য কোথায়...?
বেগম জিয়া বললেন "২৬ মার্চ জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক দিন। এদিনে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।"স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে বেগম জিয়ার এই নতুন বক্তব্য পড়ে হাসতে ইচ্ছা করলেও হাসতে পারলাম না। কারণ এতদিন জানতাম মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন এবং কোনদিন কারও কাছে শুনিনি যে জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে বেগম জিয়া বললেন "২৬ মার্চ জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক দিন। এদিনে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

"****মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি চেতনা অন্তরে লালন করে থাকি। বাংলা আর বাঙালী ছাড়া অন্তরে আর কিছুই খুঁজে পাই না। বাংলা ভাষা, বাঙালিত্ব এই ধারণ করে স্বাধীনতার এই চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে স্বাধীনতার ইতিহাসের কোথাও জিয়াউর রহমানের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল বাঙালীর স্বাধীনতা আর সংগ্রামের ইতিহাস। বাঙালীদের দীর্ঘ ২৩ বছরের এই সংগ্রামী জীবনে জিয়াউর রহমান কোথায় ছিলেন?

*******মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশীদের কাছে মেজর জিয়াউর রহমান একটি প্রায় অপরিচিত নাম ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষা, নাকি উর্দু এই নিয়ে বাঙালী আর পাকিস্তানীদের মধ্যে শুরু হয় মতবিরোধ। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বীজ বপন হয় বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালীদের জীবনে আসে '৫২ সালের একুশে ফেরুয়ারি। ভাষার জন্য এদিন প্রাণ দেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। ২১ দফা দাবি নিয়ে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ থেকে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজাম-ই-ইসলাম ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২১ দফা দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই নির্বাচনে ২৩৭টি সিটের মধ্যে ২১৫ ভোট লাভ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজাম-ই-ইসলাম ঐক্যজোট। নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪২ সিট, কৃষক-শ্রমিক দল পায় ৪৮, নেজাম-ই-ইসলাম পায় ১৯ সিট এবং গণতন্ত্রী পার্টি ১৩ সিটসহ সর্বমোট ২২২ সিট নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করে। কিন্তু বানোয়াট অভিযোগে পাকিস্তানের সেন্ট্রাল গবর্মেন্ট ১৯৫৪ সালের ২৯ মে এই সরকারকে বাতিল করে দিয়ে নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপন করে।

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা, বাঙালী আর বাংলা ভাষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের প্রায় পুরোটা সময় পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কারাগারে জেল খাটেন। ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আবারও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।ধীরে ধীরে বাঙালীর আন্দোলন দানা বাঁধে। বাঙালীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফার আন্দোলনের ডাক দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই ৬ দফা পুরো পূর্ব বাংলায় বাঙালীদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি করে। একদিকে বাঙালীরা শুরু করে 'সিক্স পয়েন্ট মুভমেন্ট।' অন্যদিকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙালীর কণ্ঠরোধ করার জন্য আবারও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। পুরো দুই বছর তিনি জেলে কাটান। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সামরিক আইনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করে যা পরবর্তীতে "আগরতলা ষড়যন্ত্র" হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।কিন্তু বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা 'বঙ্গবন্ধু' নামে পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বাঙালীদের আন্দোলনের তীব্রতা দেখে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে বেরিয়ে এসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে আয়োজিত এক জনসমাবেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে 'বাংলাদেশ' হিসেবে নাম দেন। সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন, "আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে 'বাংলাদেশ' নামে ডাকা হবে। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় সারা পাকিস্তানে ঝড় ওঠে। বাঙালীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বুনতে থাকে।১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাইক্লোন 'ভোল' আঘাত হানে এবং এই সাইক্লোনের আঘাতে প্রায় ৫ লাখ জীবন হারায়। আরও লাখ লাখ বাঙালী হারায় ঘরবাড়িসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। সাইক্লোনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীদের প্রতি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কোন কিছু না করা বাঙালীদের তাদের স্বাধিকারের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭০ নির্বাচন। এই নির্বাচনে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয় লাভ করে।নির্বাচনে জয়লাভ করে মুজিব বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। কিন্তু মুজিবের দলের ভিতরে দাবি ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার।
পাকিস্তানী সামরিক শাসক বাঙালীদের অধিকারের কোন মূল্য না দিয়ে শুরু করে বাঙালীদের ওপর নির্মম অত্যাচার; আর এরই ধারাবাহিকতায় আসে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ "...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ভাষণের পর পরই বাঙালীরা স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানীদের বিতাড়নের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে।২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পরই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। শুরু হয় বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্ত হয়।কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বছর না যেতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও জাসদের ভাগ হয়ে দেখা দেয় মতা আর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সম্মিলিতভাবে শিশু রাষ্ট্রটিকে গড়ার কাজে লিপ্ত না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপরে শক্তির মধ্যে শুরম্ন হয় রাজনৈতিক আর মতার বিরোধ। একদিকে রাষ্ট্রীয় মতায় আসীন আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর অন্যদিকে মতার বাইরে থাকা জাসদের সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বের ফলে দুই মুক্তিযুদ্ধের শক্তির মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ। আর এই বিরোধের মধ্যে আগুন দেয় দেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে থাকা এন্টাই লিবারেশন ফোর্স হিসাবে চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াত শিবির, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনী। শুরু হয় জাসদের সশস্ত্র বিপ্লব। জাসদের এই সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনার পাশাপাশি মুত্তিযুদ্ধের পর পালিয়ে থাকা পরাজিত ঘাতকরা সংগঠিত হতে শুরু করে। যুক্ত হয় দেশী বিদেশী যড়যন্ত্র। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্নেল আবু তাহেরকে সামনে রেখে শুরু হয় জাসদের সশস্ত্র বিপ্লবের নীলনকশা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্নেল আবু তাহের ১৯৭২ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে প্রমোশন লাভ করেন। কিন্তু কর্নেল আবু তাহের জাসদভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একীভূত হবার ফলে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে কর্নেল আবু তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।কর্নেল আবু তাহেরের সক্রিয় জাসদে যোগদান সেনাবাহিনীতে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ননকমিশন্ড অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের উজ্জীবীত করে এবং পাশাপাশি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাসদকে উজ্জীবিত করে তোলে।একদিকে কর্নেল আবু তাহেরকে সামনে রেখে জাসদ আর সেনাবাহিনীর বঞ্চিত সেনা অফিসার ও সৈনিকদের একত্রীকরণ, আর অন্যদিকে জাদসের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীলনকশা আর এই নীলনকশার মধ্যে উস্কানি দেয় পালিয়ে থাকা দেশবিরোধী শক্তি জামায়াত শিবির রাজাকার আলবদর আলশামস বাহিনীর সদস্যরা আর দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। জাসদের সশস্ত্র বিপ্লব, সেনাবাহিনীর বঞ্চিত অফিসার সৈনিকদের সঙ্গে পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রে সঙ্গে দেশী বিদেশীদের চক্রান্তকারীদের সক্রিয় পরিকল্পনায় ক্ষমতা দখলের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ তৎকালীন সেনা অফিসার জিয়াউর রহমানের সক্রিয় সম্মতির নিয়ে কর্নেল ফারুক-রশিদের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর পুরো পরিবারকে।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধের সপরে শক্তিকে মতা থেকে চিরতরে হটানোর নীলনকশার ধারাবাহিকতায় ঘটানো হয় ৩ নবেম্বরের জেল হত্যাকান্ড। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। জাসদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর দেশবিরোধীদের নীলনকশায় একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের সপরে শক্তির নেতাদের হত্যাকান্ডের ফলে মতা দখল করে নেয় মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ। বন্দী করা হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সেনাবাহিনীর বঞ্চিত সেনা অফিসার আর সৈনিকদের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে কর্নেল আবু তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেন। কর্নেল তাহেরের এই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে হত্যা করা হয় সেনাবাহিনীর শত শত অফিসার ও সৈনিক। বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়াউর রহমান প্রধান বিচারক আবু সাঈদ মোহাম্মদ সায়েমকে সঙ্গে নিয়ে মার্শাল ল জারির মাধ্যমে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন।১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পরে কর্নেল তাহের বুঝতে পারেন, যে উদ্দেশ্যে তিনি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়েছেন তা বিফল হয়েছে। সফল হয়েছে জিয়াউর রহমানের প্রতি বিপ্লব। কিন্তু কর্নেল আবু তাহেরের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান সেনাবাহিনীতে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং কর্নেল আবু তাহের জিয়াউর রহমানকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য হুমকি দিতে শুরু করলে বিপদ টের পেয়ে ১৯৭৫ সালের ২৪ নবেম্বর জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন।ক্ষমতা দখলের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি জামায়াত শিবির-রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যদের রাজনীতি করবার সুযোগ করে দেয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে জিয়াউর রহমান সক্রিয় রাজনীতি করা শুরু করেন। জিয়াউর রহমানের এই রাজনীতির ছায়াতলে দেশের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়ো হতে শুরু করে। একদিকে জিয়াউর রহমানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, দেশবিরোধী জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদর-আলশামস্ বাহিনীর রাজনীতির অনুমতি প্রদান সবকিছু মিলিয়ে যাত্রা শুরু হয় এক নতুন বাংলাদেশের। এই নতুন বাংলাদেশের মতার শীর্ষে চলে আসে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি।১৯৭৮ সালের নির্বাচনে জিয়াউর রহমান ৫ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের নবঘটিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ৩ শ' সিটের মধ্যে ২০৭ সিট পেয়ে বিজয় লাভ করে। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই বাংলাদেশ একটি নতুন পথে যাত্রা শুরু করে এবং এই যাত্রায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পায়ে পায়ে হাতে হাতে চলতে শুরু করে ধর্মীয় রাজনীতি। ধর্মের নামধারী দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনী ধর্মের নাম নিয়ে ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং '৮০-এর দশকে এই ধর্মীয় রাজনীতি বাংলাদেশের সর্বত্র এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। শুরু হয় রগকাটার রাজনীতি।কিন্তু দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি আর সেনা বিদ্রোহের উন্মাদনা হতে জিয়াউর রহমানও রেহাই পাননি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর একটি বিদ্রোহে জিয়াউর রহমানকে প্রাণ হারাতে হয়। যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেই ক্ষমতা দখলের ছয় বছরের মাথায় তাঁকেও সেই ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয়। পিছনে রেখে যান বিধবা স্ত্রী, দুই সন্তান আর ভাঙ্গা একটি ব্রিফকেস। হত্যার এই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সামরিক প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখল করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং দেশে ধর্মীয় রাজনীতি চালু রাখেন।
১৯৮৩ সালে জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ভারতে জন্মগ্রহণকারী বেগম খালেদা জিয়াকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং ১৯৮৪ সালের ১৪ আগস্ট বেগম জিয়া বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বেগম জিয়া ও তাঁর জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং বেগম জিয়াও দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির ছায়ায় রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন।১৯৯১ সালের বিএনপি ও জামায়াত-শিবির জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই একদিকে যেমন শুরু হয় ধর্মীয় রাজনীতির উন্মাদনা, অন্যদিকে শুরু হয় বেগম জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের ভয়ঙ্কর উত্থান। সরকারের মদদে এই সময় তারেক রহমান টেঙ্টাইল মিল, শিপিং ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন তিনি। ধীরে ধীরে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটসহ নানা অপরাধ। বিএনপির ঘাড়ে চড়ে দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনী নৃশংসভাবে ঝঁপিয়ে পড়ে দেশের সংখ্যালঘু ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির উপর। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত শিবিরের ভয়াবহ এই উত্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহভাবে উত্থান ঘটে তারেক রহমানের।বিভিন্ন দুর্নীতি আর ধর্মীয় রাজনীতির উন্মাদনার মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও রাজনৈতিক অন্দোলনের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় চারদলীয় জোট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ জুন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এবং বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে।১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ভারতের সঙ্গে বহুল আলোচিত ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে ৩৩ হাজার কিউবিক পানি প্রতি সেকেন্ডে পাবার নিশ্চয়তা বিধান হয়। এ ছাড়া পাহাড়ী আদিবাসীদের সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের জন্য 'শান্তি চুক্তি' করে। এই চুক্তির ফলে পাহাড়ী এলাকা শান্তি স্থাপিত হয় এবং বিদ্রোহীরা তাদের অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দেয়। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস পাল্টে দেয়া হয়েছিল তা সঠিক করতে উদ্যোগ নেয়।২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া।

২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সারা বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু হিন্দু ও আহমেদীয় সমপ্রদায়ের ওপর বীভৎসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনী। হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সংখ্যালঘুদের ওপর পাশবিক অত্যাচার, বাড়িঘর লুটপাট এবং প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হত্যা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।একদিকে জোট সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কালো ছায়া, অন্যদিকে দেশদ্রোহী জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস্ বাহিনীর রগকাটা রাজনীতির পাশাপাশি ভয়াবহভাবে উত্থান ঘটে বহুল আলোচিত হাওয়া ভবন। বেগম জিয়ার সরকারের পাশাপাশি চালু হয় তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবন প্রশাসন। বেগম জিয়ার জোট সরকারের পাশাপাশি তারেক রহমানের হাওয়া ভবন শাসনে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দেশে চলে দু'টি পাশাপাশি সরকারের কার্যক্রম। সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির এবং এক পর্যায়ে সরকারের সকল কার্যক্রমকে ছাড়িয়ে আলোচনা, ক্ষমতা আর শাসনের শীর্ষে উঠে আসে হাওয়া ভবন।যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির-রাজাকার- আলবদর-আলশামস্ বাহিনীর সঙ্গে জোট বেঁধে বেগম জিয়ার সরকার দেশের ইতিহাস বিকৃত করে মরহুম জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলার কি কুৎসিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল যা জিয়াউর রহমান খোদ ক্ষমতায় থাকতে করতে সাহস পায়নি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকতে যে স্বাধীনতার দলিল তিনি রচনা করেছিলেন সেখানেও তিনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেননি। কিন্তু ২০০৩/৪ সালে জিয়াউর রহমান কর্তৃক রচিত সেই স্বাধীনতার দলিল সংশোধন করে জিয়াউর রহমানকে বেগম জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক বানাবার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।বর্তমান বিএনপির আশপাশে এখনও সুবিধাবাদী দুর্নীতিবাজরা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। বিএনপিকে এখনও ঘিরে আছে জঙ্গীবাদী জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদরেরা। আরও আছে দেশে প্রবাসে খাম্বা মামুনের মতো বহু খাম্বা মামুন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এইসব দুর্নীতিবাজদের দল থেকে বহিষ্কার অতীব জরুরি।দেশের মানুষ আন্দোলন চায় না। দেশের মানুষ হরতাল চায় না। দেশের মানুষ দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা চায়। শিক্ষিত নেতৃত্ব চায়। বাংলাদেশ পিছিয়ে যেতে পারে না। তথ্যপ্রযুক্তি আর কানেকটিভিটির মাধ্যমে বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কানেকটিভিটি আর সুসম্পর্কের মাধ্যমে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে তথ্য প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধিশালী হয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা কোন দল বা ব্যাপ্তি বা পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে না। রাসত্মার আন্দোলনের পরিবর্তে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে সংসদে এসে মানুষের কথা বলতে হবে। সরকারের ভুল ত্রুটি শুধরে দিতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির রাস্তা থেকে সরে আসতে হবে। জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। দেশের আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করে দেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশে পরিণত করার কাজে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি পরিহার করে দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদদের দল থেকে বের করে দিয়ে শিক্ষিত সভ্য এবং দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দিয়ে বিএনপিকে আবারও ঢেলে সাজিয়ে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি কাজ করতে পারলে হয়ত বাংলাদেশে জিয়া পরিবারের নাম সুনামের সহিত অক্ষুণ্ন থাকবে। কিন্তু তা না হলে কোন এক পাকিস্তান বা জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের কাঁধে বসিয়ে জিয়া পরিবারকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day