বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : বিজয় পূর্ণতা পায় যেদিন
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : বিজয় পূর্ণতা পায় যেদিন
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে প্রায় ৯৩ হাজার পাকসেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২৬৬ দিনের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান হলো, অর্জিত হলো আমাদের কাঙিৰত বিজয়। সেদিন থেকেই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। ক্যালেন্ডারের পাতায় ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ শুধুই আমাদের, আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিৰিত ও পেশাদার পাকসেনার বিপরীতে বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার লাঠি, তীর, ধনুক ও মান্ধাতার আমলের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নিতান-ই ছিল একটি অসম যুদ্ধ। যে বাঙালিকে তারা ভীর" ও কাপুর"ষ বলে তিরস্কার করতো, সৈনিক হিসেবে যে বাঙালিকে কখনই উপযুক্ত বলে মনে করতো না সেই বাঙালি জাতি যে তাদেরকে পরাজিত করে বিশ্ব দরবারে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে তা তাদের বোধগম্য ছিল না। বাঙালির এ বীরত্বের কাহিনী তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। বাঙালি তাদের এ অসাধ্য সাধনের মূলমন্ত্র মূলত খুঁজে পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। তর্জনী উঁচিয়ে সেদিন তিনি উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন প্রতিটি বাঙালিকে। বজ্রকণ্ঠ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক এই দৈববাণীর মতো গগন বিদারী কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল কিছু ভবিষ্যদ্বাণী ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। জলদগম্ভীর স্বরে তিনি ঘোষণা করেছিলেন তার নির্দেশাবলী- ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা আছে তাই দিয়ে শত্র"র মোকাবেলা করতে হবে। সর্বস-রের বাঙালি অৰরে অৰরে তার নির্দেশ পালন করলো। আমরা বিজয় পেলাম অনুপসি'ত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বিশ্বের সর্বত্র শ্রদ্ধেয় জননেতা। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা শব্দ তিনটি তখন সমার্থক। যেন স্বাধীনতা মানেই বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা। তাই কাঙিৰত বিজয় অর্জিত হলেও বাঙালির হৃদয়ে অপূর্ণতা রয়ে গেলো। কারণ বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হলেও বিজয়ের মহানায়ক তখনো মুক্ত হননি। তখনো তিনি পাকিস-ানি খলনায়কের কারাগারে বন্দী। পূর্ণ বিজয়ের স্বাদ পেতে হলে বঙ্গবন্ধুকে চাই তার মুক্ত স্বদেশে।
অতএব তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা, তাদের আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবকে মুক্তাবস'ায় কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লো। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ইয়াহিয়ার দোসর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথমত গড়িমসি করলেও বিশ্ববিবেকের প্রবল চাপে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বিনাশর্তে মুক্তিদানের কথা ঘোষণা করলো। চতুর ভুট্টো ঐ দিনই করাচির এক জনসভায় বক্তৃতা দানকালে জনতার কাছে জানতে চাইলো তারা শেখ মুজিবের মুক্তিদানের সঙ্গে একমত কিনা? জনতা এক বাক্যে হ্যাঁ সূচক রায় দিলেন। এরপর ভুট্টো বলেন, ‘আমি এখন ভারমুক্ত হলাম’। শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হবে। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমান লন্ডন অভিমুখে রওনা হয়। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট এবং লন্ডন সময় ৬টা ৩৬ মিনিটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে তার বিমান অবতরণ করে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রয়াল এয়ার ফোর্সের একখানি কমেট বিমানযোগে লন্ডন থেকে নয়াদিলিস্ন পৌঁছেন। সেখানে পেলাম বিমানবন্দরে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি, ভিপিগিরি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ ও বিদেশী কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা তাকে অভ্যর্থনা জানান। দিলিস্ন প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসমাবেশে বাংলায় মর্মস্পর্শী ভাষণদানের পর ঐ দিনেই বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ১টা ৪১ মিটিটে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বাঙালি জীবনের আর এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা, নিপীড়িত জনতার আশা-আকাঙৰার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবকে দেখার জন্য লৰ লৰ জনতার ঢাকা বিমানবন্দরে জমায়েত হওয়ার সে দৃশ্যের বর্ণনা তখন দৈনিক বাংলায় পাওয়া যায় এইভাবে ‘রূপালী ডানার মুক্ত বাংলাদেশের রোদ্দুর, জনসমুদ্রে উলস্নাসের গর্জন, বিরামহীন করতালি, স্লোগান আর স্লোগান। আকাশে আন্দোলিত হ"েছ যেন এক ঝাঁক পাখি। উন্মুখ আগ্রহের মুহূর্তগুলো দুরন- আবেগে ছুটে চলেছে। আর তর সইছে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন রক্তস্নাত বাংলার রাজধানী ঢাকা নগরীতে দখলদার শক্তির কারা প্রাচীর পেরিয়ে। আমার সোনার বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি, হৃদয়ের রক্ত গোলাপ শেখ মুজিব এসে দাঁড়ালেন। আমাদের প্রত্যয়, আমাদের সংগ্রাম, শৌর্য, বিজয় আর শপথের প্রতীক বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তার স্বজনের মাঝে। চারধারে উলস্নাস, করতালি, আকাশে নিৰিপ্ত বদ্ধ মুঠি, আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়া পরিবেশ- যা অভূতপূর্ব, শুধু অভূতপূর্ব। এই প্রাণাবেগ অবর্ণনীয়।’ (দৈনিক বাংলা, ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২)
তেজগাঁওস' বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। গাড়ি যাত্রায় মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। অথচ জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ভেদ করে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। লাখ লাখ জনতার সমাবেশের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মতোকেঁদে ফেলেন। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি প্রথমবারের মতো স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে এক হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। ৭ মার্চের সেই সিংহপুর"ষ যিনি এখানে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠেছিলেন এই বলে যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজ তার চোখে কান্না। না, এ কোনো পরাজয়ের গ্লানি নয়, বিজয়ের আনন্দ। তার এ কান্না কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ হারানোর কান্না নয়। নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা থেকে বি"িছন্ন থাকার বেদনার বহিঃপ্রকাশ নয়। এ ছিল নিপীড়িত, নির্যাতিত, গৃহহারা, আশ্রয়হারা মানুষ তথা দেশমাতৃকার প্রতি মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। হাজার মাইল দূরবর্তী ইয়াহিয়ার কারাগারে যখন তার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, তার সেলের পাশে যখন তার কবর খোঁড়া হয়েছিল- মৃত্যু প্রতীৰায় থাকা সে সময় তার চোখে পানি আসেনি, অথচ দেশের মানুষের দুর্দশা স্বচৰে দেখার পর তিনি চোখের পানি রোধ করতে পারেননি।
এ সেই মহাত্মা যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নিজের পরিবার-পরিজনের কথা না ভেবে বাঙালির মুক্তির কথা ভেবেছেন। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে মেরে ফেলো আমার কোনো দুঃখ নেই। শুধু আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও। আমি বাঙালি বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা”। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ স্বাধীন দেশে তার প্রথম ভাষণ দানকালে যখন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে বলেছিলেন, “আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’ বাঙালির অনুভূতিতে তখন এক নতুন সংযোজন। আজ তারা শুধু স্বাধীনই নয়, তারা ফিরে পেয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। মহাত্মার প্রত্যাবর্তনে তাদের বিজয় আজ পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণতা পেয়েছে স্বাধীনতা।
তেজগাঁওস' বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। গাড়ি যাত্রায় মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। অথচ জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ভেদ করে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। লাখ লাখ জনতার সমাবেশের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মতোকেঁদে ফেলেন। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি প্রথমবারের মতো স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে এক হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। ৭ মার্চের সেই সিংহপুর"ষ যিনি এখানে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠেছিলেন এই বলে যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজ তার চোখে কান্না। না, এ কোনো পরাজয়ের গ্লানি নয়, বিজয়ের আনন্দ। তার এ কান্না কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ হারানোর কান্না নয়। নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা থেকে বি"িছন্ন থাকার বেদনার বহিঃপ্রকাশ নয়। এ ছিল নিপীড়িত, নির্যাতিত, গৃহহারা, আশ্রয়হারা মানুষ তথা দেশমাতৃকার প্রতি মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। হাজার মাইল দূরবর্তী ইয়াহিয়ার কারাগারে যখন তার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, তার সেলের পাশে যখন তার কবর খোঁড়া হয়েছিল- মৃত্যু প্রতীৰায় থাকা সে সময় তার চোখে পানি আসেনি, অথচ দেশের মানুষের দুর্দশা স্বচৰে দেখার পর তিনি চোখের পানি রোধ করতে পারেননি।
এ সেই মহাত্মা যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নিজের পরিবার-পরিজনের কথা না ভেবে বাঙালির মুক্তির কথা ভেবেছেন। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে মেরে ফেলো আমার কোনো দুঃখ নেই। শুধু আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও। আমি বাঙালি বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা”। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ স্বাধীন দেশে তার প্রথম ভাষণ দানকালে যখন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে বলেছিলেন, “আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’ বাঙালির অনুভূতিতে তখন এক নতুন সংযোজন। আজ তারা শুধু স্বাধীনই নয়, তারা ফিরে পেয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। মহাত্মার প্রত্যাবর্তনে তাদের বিজয় আজ পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণতা পেয়েছে স্বাধীনতা।
মোঃ আনোয়ার"ল ইসলাম ফার"ক শিৰক ও কলাম লেখক