Mother of all terror’.সিরাজ শিকদারঃ মুক্তিযোদ্ধা না জনবিচ্ছিন্ন, মার্ক্সবাদী একনায়ক!

সিরাজ শিকদারঃ মুক্তিযোদ্ধা না জনবিচ্ছিন্ন, মার্ক্সবাদী একনায়ক!

বিগত ৩৫ বছর ধরে প্রতি বছর জানুয়ারী মাসে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতা, তোতা পাখীর মতো সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার এর দাবী তুলেন ( বিশেষত যখনি বঙ্গবনধু হত্যার বিচারের দাবী উঠত) এবং তার পরই যখন তাদের দল যখন ক্ষমতায় আসে বা থাকে, তখন কিছুদিনের জন্য সেই দাবি ভুলে শীত নিদ্রায় চলে যান। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে ’ক্রস ফায়ারে’ সিরাজ শিকদার’এর নিহত হবার পরে সুদীর্ঘ ২১ বছর এই দলগুলি ক্ষমতায় ছিল। সেই একুশ বছরে এই দলগুলি কিন্তু সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার এর কোন উদ্যোগ গ্রহন করে নাই।

আসুন না, নিরপেক্ষ দৃস্টিতে দেখি সিরাজ সিকদারের কর্মবহুল জীবন। ফিরে দেখা যাক, সেই দিনগুলি আর তখনকার পরিস্থীতি।

প্রথমে দেখা যাক, কে ছিল এই সিরাজ সিকদার?
এককালীন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর সক্রিয় কর্মী এবং পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সিরাজ সিকদার ছিলেন পেশায় প্রকৌশলী। সিরাজ সিকদার, ১৯৬৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম শ্রেনীতে ডিগ্রী লাভ করেন। সি এন্ড বি তে প্রকৌশলী হিসাবে যোগদানের তিনমাসের মধ্যেই তিনি চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন এবং পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাটি গঠন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদার? সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পাটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সিরাজ সিকদার এবং তার গঠিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পাট্‌, িশ্রেনী সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নয়। সিরাজ সিকদার নিজেই তা পরিস্কার করেছেন তার লেখা ‘গন যুধ্বের পটভূমি‘ বইয়ে। তার ভাষায় মুক্তিযোদ্ধ ছিল, ‘দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি‘ আর মুক্‌ত্িযোদ্ধারা তো ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর‘! ১৬ ডিসেম্বর কে তিনি বিজয় দিবস মনে করতেন না! তাই দুই বিজয় দিবসএ (৭৩ ও ৭৪ সালে) হরতাল এর ডাক দিয়েছিলেন!
তথ্যমতে, সিরাজ সিকদার ও তার দল মাত্র একবারই পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিল বরিশাল জেলার ‘পেয়ারা বাগানে‘।‘পেয়ারা বাগানের সংঘর্ষ, সে তো পাক বাহিনীর সামনে দূর্ভাগ্যক্রমে পড়ে যাওয়ার ফল, পরিকলপীত কোন যূদধ নয়। সিরাজ সিকদার ও তার দল তার চেয়ে অনেক বেশী বার সংঘর্শে লিপ্ত হয়েছিল মুক্তি বাহিনীর সংগে। সিরাজ সিকদার নিজেকে কক্ষোনো মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন নাই, তাই সিরাজ সিকদারকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করার কোনো ভিত্তি বা যৈক্তিকতা নাই।
স্বাধীনতা পরবতী্‌ সময়ে (১৯৭২ - ১৯৭৫), তাদের ভূমিকা ছিল চরম হঠকারী এবং সনত্রাসপূর্ন। শ্রেণী সংগ্রামের নামে তারা খুন করেছিলো হাজ়ার হাজার নিরীহ মানুষকে। এমনকি ইদের জামাত এ নামাজরত অবস্থায় সংসদ সদস্য কেও খুন করেছিল সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পাটি। এখন আমরা দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারা পাট্রি যে তান্ডব দেখি, তা সেদিনের তুলনায় ন্যসি মাত্র! এক কথায়, সিরাজ সিকদার ও তার দল ছিল Mother of all terror’. স্বাধীনতা পর সিরাজ সিকদার এর মেধা এবং ব্যাত্তিতের কারনে কিছু মুক্তিযোদ্ধা তার দলে যোগ দেন। তার মদ্ধে কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ(অব) বীর উত্তম, উল্লেখযোগ্য। পরে মতবিরধের কারনে তিনি সিরাজ সিকদার এর দলত্যাগ করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দলত্যাগ, বহিস্কার, মৃত্যু/হত্যার মধ্য দিয়ে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিরাজ সিকদার ক্রমান্নয়ে দলের এক সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিতে পরিনত হন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অপর বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের (অব) বীর উত্তম, যোগদান করেন জ়াসদের গনবাহিনীতে, সমাজ বদলের স্বপ্ন নিয়ে। বীর মুক্‌ত্িযোদ্ধা কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অব) ও কর্নেল তাহের (অব), মেজর জলিল (অব), ফিদেল কাস্ত্রোর মত জাতীয়তাবাদী থেকে সমাজতন্ত্রীতে পরিনত হয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে মেজর জলিল (অব), যোগদান করেন জাসদে এবং সভাপতির পদ পান।
পরবর্তী সময়ে মেজর জলিল(অব), সমাজতন্ত্রীতে থেকে মৌলবাদিতে পরিন্‌’ত হন, হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে! এই সব যোগদানের ফলে কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল তাহের, প্রমুখ তাদের আগের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং অবস্তান থেকে আরও বামে বা মেজর জলিল, প্রথমে বামে ও পরে ডানে সরে যান। সিরাজ সিকদার কিংবা হাফেজ্জী হুজুর কিন্তু তাদের স্ব স্ব অবস্তানই থাকেন।
জনবিচ্ছিন্ন তাত্তিক রাজনীতিঃসিরাজ সিকদার এবং সিরাজুল আলম খানের মত মেধাবী, তাত্তিক কিন্তু বিপদ্‌গামী এবং খমতা লিপ্‌সু নেতাদের কারনে স্বাধীনতা পরবতী্‌ সময়ে (১৯৭২ - ১৯৭৫), অনেক প্রতিভাবান যুবক অকারনে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। তাদের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাটি ও গন বাহিনীর মত সংগঠন এ যোগ দিয়ে অকারনে জীবন দিয়েছিল হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুন ও যুবক। এই দুই মেধাবী ও তাত্তিক নেতা, বাংলাদেশের মানুষের মন মানসিকতা,সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় প্রভাব বুঝতে ব্যার্থ হয়েছিলে। তাই তাদের শ্রেনী সংগ্রাম এর স্বপ্ন এই দেশের মাটিতে কখনোই দৃঢ় শেকড় গাড়তে পারেনি।
এর বিপরীতে আমারা দেখতে পাই অপর দুই মেধাবী, ত্যাগী দেশপ্রেমিক, যারা বাস্তবতার নীরিখে তাদের অবস্‌হান থেকে সরে এসে এই দেশ ও মানুষের জন্য অপরীসিম অবদান রেখে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। প্রথম জীবনে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও, পরবরতীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অতন্ত্য দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজুদ্দিন আহমদ।
অন্যজন হচ্ছেন প্রথম জীবনে বামপন্থী নেত্রী, মতিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশের ইতিহাসে কৃষি ও কৃষকের জন্য এত নিবেদিত প্রান নেতা/নেত্রী সত্যি বিরল। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তার অবদান এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে! এই দুই নেতা/নেত্রী, বাম থেকে আরো বামে না সরে, বাস্তবতা উপলব্ধী করে কিছুটা ডানে সরে এসে আওয়ামী লীগের মত বড় দলে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের মত বড় দলকে ‘সফফ ধপষয়ড়প লপফয়‘ দলে পরিনত করতে গুরুত্তপূর্ন ভুমিকা পালন করেন। মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রমূখ একই পথ অবলম্বন করেন।
সিরাজ সিকদার’এর শেষ দিনগুলিঃ
সেই অবস্তায়, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর এর শেষ দিন গুলিতে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন সিরাজ সিকদার এবং কয়েক দিনের মাথায় (গ্রেফতার হওয়ার দিন তারিখ নিয়ে মানুষের মদ্ধে কিছু মতভেদ আছে), ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে ২ জানুয়ারী সাভারে ’ক্রস ফায়ারে’ নিহত হন। সিরাজ সিকদার মৃত্যুর ফলে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাটি সাংগঠনিক ভাবে ভীষন দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অনেক নীরিহ মানুষের জীবন রক্ষা পায়। যেহেতু, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাট্‌ি, সিরাজ সিকদার এর একক নেতৃতের উপর নির্ভরশীল ছিল, তাই তার মৃত্যূর কিছুদিনের মদ্ধেই তার দল অনেক উপদল এ পরিনত হয় এবং বিলুপ্তির দিকে দ্রুত ধাবিত হয়।
সেই সময় ’ক্রস ফায়ার’ ছিল একেবারে নতুন এবং মানুষ এতে অভস্ত ছিলো না। তাই সেই সময় সাধারন মানুষ কিছুটা হলেও হতবাক হয়েছিল। আজ আমরা ’ক্রস ফায়ারে’ অভস্ত হয়ে গেছি এবং বুঝি এর উপকারিতা আর কার্যকারিতা। তাই আমরা দেখি, যদিও আইনের চোখে কিছুটা অগ্রহনযোগ্য, কিন্তু বিপুল সংখা গরিস্‌ঠ জনসাধারনের কাছে ’ক্রস ফায়ার’ এর রয়েছে প্রচন্ড গ্রহনযোগ্যতা। সাধারন জনসাধারনের মনে ’ক্রস ফায়ার’ এর প্রতিশব্দ হচ্ছে, ’যেমন কুকুর, তেমন মুগুড়’।

১৯৭৫ এর পর অনেক সরকার ছিল যারা সিরাজ সিকদার এর হত্যার বিচার এর কোনো ঊদ্যোগ নেন নি! অথচ যখনি বঙ্গবনধু হত্যার প্রসঙ্গ উঠত বা সিরাজ সিকদার এর মৃত্যু দিবস আসে, তখনি সেই সব সরকার এর সাথে জড়িত নেতারা সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার এর দাবী তুলেন! অন্য সব ’ক্রস ফায়ারে’ নিহতদের মত সিরাজ সিকদার এর হত্যার বিচার দাবী করা জেতে পারে। একটি ব্যাপারে আমি নিশ্চীত যে, ’ক্রস ফায়ারে’ নিহতদের অনেকের মত সিরাজ সিকদার এর বিরুদ্ধে অনেক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে,বাস্তবতার কারনে এ ধরনের ক্রস ফায়ারের দরকার ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
সিরাজ সিকদার সাহসী, মেধাবী, নির্লোভ এবং সৎ এবং একই সাথে হঠকারী ও ভূল পথ অবল্মবনকারী যে ছিলেন , তাতে কোন সন্দেহর অবকাশ নাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য এই দুই তাত্বিক নেতা, সিরাজ সিকদার এবং সিরাজুল আলম খানের মদ্ধে, এক্‌ মাত্র সিরাজ সিকদারই আমৃত্যু তার নীতিতে অবিচল ছিলেন।
অন্যদিকে সিরাজুল আলম খান (এক সময় দাদা নামে কর্মীদের মদ্ধে জনপ্রিয় থাকলেও, পরবর্তীতে ’কাপালিক’ নামেই বেশী পরিচিতি পান), বীর মুক্তি যোদ্ধা কর্নেল তাহের (অব), বীর উত্তম কে ফাঁসির মঞ্চের দিকে ঠেলে দিয়ে, হাজার হাজার মেধাবী তরুন, যুবকের জীবন, মেধা ও সম্ভাবনার অপমৃত্যূ ঘটিয়ে, এখন স্বাভাবিক(!) জীবন যাপন করছেন।
পাদটিকাঃ বীর মুক্তি যোদ্ধা কর্নেল তাহের (অব) বীর উত্তম এর আদর্শ ও আত্মত্যাগ অনেক মেধাবী তরুন, যুবককে অনুপ্রানিত করেছিল, যেমনটি করেছিল তার তিন সহোদরকে। বীর মুক্তি যোদ্ধা কর্নেল তাহের (অব) বীর উত্তম এর অনূজ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক, এক সময়ের জাসদের গনবাহিনীর সক্রিয় জানবাজ সদস্য, অনেক ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে মুক্তিযূদ্ধের মূলধারায় ফিরে এসেছেন। তিনি এখন জাতীয় সংসদে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। আর অন্য দুই সহোদর আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম ও বাহার, বীর প্রতিক (কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেন কে অপহরনের চেষ্টাকালে নিহত), খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তি যোদ্ধা।
অন্যদিকে জনবিচ্ছিন্ন মার্ক্সবাদী সিরাজ সিকদার এর আদর্শ অনেক মেধাবী তরুন, যুবককে অনুপ্রানিত করলেও তার নিকটতম আত্মীয়দের অনুপ্রানিত বা নূন্যতম প্রভাবিত ও করতে পারেনি। তার দুই ভাই বাংলাদেশের অন্যতম বিত্তবান গার্মেণ্টস ব্যাবসায়ী। ব্যবসায়ী নুরু সিকদার ডানপন্থি দল বি এন পি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছিলেন। বোন শামীম সিকদার, বি এন পি দলীয় এক প্রাক্তন মন্ত্রীকে বিয়ে করে সংসার করছেন।

নাজমুল আহসান শেখ, সিডনী থেকে।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day