আজ বাঙালির বিজয়ের দিন
আজ বাঙালির বিজয়ের দিন
মহান বিজয় দিবস আজ বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর। আজকের প্রভাতে পূর্ব দিগন্তে যে নতুন সূর্যের উদয় হলো তার রঙ এতো লাল কেন? সেকি ‘হরিদাসী’র সিঁথির সিঁদুর মেখে, নাকি বীর মুক্তিসেনার রক্তের সাগরে স্নাত হয়ে এসেছে বলে? বিজয় আনন্দের, বিজয় গৌরবের, বিজয় মাথা তুলে দাঁড়াবার। কিন্তু বাঙালির বিজয় একাধারে বেদনারও। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে বিজয়- সে তো বেদনার অশ্রুতে সিক্ত হবেই। তবু শত বেদনার মধ্যেও, বিজয় মানেই যে উৎসব। আজ তাই বাঙালির বিজয় উৎসব। ঘরে ঘরে আজ উড়ছে বিজয় কেতন। হৃদয়ে হৃদয়ে স্ফুরিত আনন্দ প্রভা। এই বাংলাদেশ আমাদের, এই স্বাধীনতা আমাদের। বিজয় আমাদের।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির গৌরবময় বিজয়ের ৪০তম দিবস আজ। এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরবের মহিমায় সমুন্নত অনন্য এই দিনটি। এমন একটি দিনের প্রতীড়্গায় এ দেশের মানুষ প্রহরের
পর প্রহর গুনেছে, লড়াই করেছে জীবন বাজি রেখে, ঝরিয়েছে বুকের তাজা রক্ত। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। পূর্ণ হয় মুক্তিপাগল বাঙালির স্বপ্নসাধ। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশের সর্বত্র আজ আনন্দ-উৎসব, শোক ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সম্মিলনে পালিত হবে জাতীয় জীবনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই দিন- ৪০তম বিজয় দিবস।
বাঙালির জাতীয় জীবনে এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন প্রেড়্গাপটে, ভিন্ন মাত্রায়। এবার যখন আমরা বিজয় উৎসব উদযাপন করতে যাচ্ছি তখন দেশ চালাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনায় ঋদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ মাস বয়সী এই সরকার এরই মধ্যে শুরু করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া। চিহ্নিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে গোটা জাতি আজ একাট্টা। এবারের বিজয় দিবসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করবে জাতি। শপথ নেবে একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের নির্মূল করার।
এদিকে, উচ্চ আদালতের রায়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে ’৭২-এর সংবিধান। ফিরে এসেছে সংবিধানের ৪ মূলনীতি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেড়্গতা। বাংলাদেশ আবার ফিরে এসেছে সাংবিধানিকভাবে অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্রের ধারায়। রুদ্ধ হয়েছে ধর্মের জিগির তুলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পথ। এই অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নিঃসন্দেহে এক ধাপ অগ্রগতি।
বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি। বীরত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস এ জাতির গৌরবময় ঐতিহ্যেরই অংশ। তবুও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির জন্মভূমি হয়েছে বহিরাগত শাসক-শোষকদের করতলগত। হানাদার বিদেশী শাসকরা বারবার আক্রমণ ও দখল করেছে এ দেশের শাসনদণ্ড, লুণ্ঠন করেছে সম্পদ, শোষণ-নিষ্পেষণে করেছে জর্জরিত। কিন্তু কোনোভাবেই পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে কেড়ে নিতে। তাই সুযোগ পেলেই এ দেশের মানুষ করেছে বিদ্রোহ। শত্রুর বিশাল শক্তিমত্তা জেনেও অসীম সাহসে নেমেছে অসম লড়াইয়ে। বাঙালির এই লড়াই-সংগ্রামেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই শাসকগোষ্ঠী বাঙালির অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানে। ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা উভয় স্থানেই তাৎড়্গণিকভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ছাত্র সমাজের এ প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস উপলড়্গে আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় পূর্ব বাংলার সচিবালয় ইডেন বিল্ডিংয়ের গেট থেকে পুলিশ শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে নিড়্গেপ করে। দিনে দিনে ছাত্র সমাজের ভাষার অধিকারের এ আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের এক পর্যায়ে কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকেই হতাহত হন। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের’ অনমনীয় এ আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক গোষ্ঠী বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন নিছক একটি ভাষা আন্দোলনই ছিল না। এ আন্দোলন ছিল বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্ব রড়্গার একটি সংগ্রামের সূচনা। এ ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিড়্গা সংকোচন নীতি ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম।
পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোয় বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ সম্ভব নয় বিবেচনা করে মূলত ১৯৬২ সালেই তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তার উন্মেষ ঘটে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এ ছাত্রনেতারা গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির লড়্গ্যে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ ‘স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী পরিষদ’ গঠন করেন সংড়্গেপে যাকে ‘নিউক্লিয়াস’ বলা হতো। ’৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ৬ দফাই ছিল মূলত বাঙালির মুক্তি সনদ। পরবর্তী সময়ে ৬ দফাকে ধারণ করে ছাত্ররা ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ৬ দফা ও ১১ দফা বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। এ সময় পাকিস্তান সরকার মিথ্যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত ও বন্দী করে। এতে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ’৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ড়্গমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার গণদাবিকে উপেড়্গা করতে পারেনি- সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ’৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাংবিধানিক প্রথা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ড়্গমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ড়্গমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ’৭১ সালের ১ মার্চ এক বেতার ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ আহূত পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিগর্ভ ভাষণ, তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- জাতির চূড়ান্ত লড়াই-সংগ্রামের পথ দেখায়। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও।
এদিকে সংকট নিরসনে আলোচনার নামে কালড়্গেপণ শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। এই কালড়্গেপণের সুযোগে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এ দেশে নিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র। তারপর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল অতর্কিত আক্রমণে বাঙালি হতচকিত হয়ে পড়বে, হত্যা নির্যাতনের ভয়ে স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করবে। কিন্তু তারা জানতো না বাঙালির আপোসহীন বীরত্বের ইতিহাস। তারা অনুভব করতে পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা কতোটা তীব্র, অদম্য। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে হতবাক করে দিয়ে সেই কালরাতেই রুখে দাঁড়ায় স্বাধীনতাকামী বাঙালি। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার কোনো পরিমাপ হয় না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মাটি। সম্ভ্রম হারিয়েছেন, চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ লাখ মা-বোন। জাতি এ যুদ্ধে হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যুত্তরে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বিজয় অর্জনের লড়্গ্যকে সামনে রেখে অকুতোভয় বাঙালি জাতি যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তার সমাপ্তি হয় আনন্দ বেদনার সম্মিলনে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর।
২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায় ঢাকাসহ দেশের সবগুলো বড় শহর ও সেনানিবাসে বাঙালি রেজিমেন্টগুলোর ওপর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাত ১২টার পর তার ধানমণ্ডির বাসভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। বন্দী হওয়ার পূর্বে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা অয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে সারা দেশে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লিফলেট আকারে বিলিও করা হয়। পরে ২৭ মার্চ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পড়্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণা বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার প্রচার করা হয়।
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনতার সহযোগিতায় মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু শক্তিশালী, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকতে না পেরে প্রতিরোধ যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল নির্বাচিত সাংসদরা ভারতের আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এ সরকার স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। স্বাধীনতার সনদ বলে এ সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৭ এপ্রিল এই প্রবাসী সরকার মেহেরপুরের ভবেরপাড়ায় (বৈদ্যনাথতলা) আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শপথ গ্রহণের এ স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগরে শপথ নেয় বলে এ সরকার মুজিব নগর সরকার নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এ সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। এ সরকারের নেতৃত্বে এবং বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতায় পরিচালিত হয় দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।
অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙিড়্গত বিজয়। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী তার ৯৩ হাজার সৈন্য এবং বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন ’৭১-এর এই দিনে। আর সেই থেকে এই দিনটি হয়ে ওঠে আমাদের বিজয়ের স্মারক- ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস।
দড়্গ ও শক্তিশালী বলে কথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আজ থেকে ৩৯ বছর আগের এই দিনে বাঙালির দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৌর্য-বীর্যের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সেই মহান বিজয়ের দিন আজ। এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক এসব বাণীতে তারা দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিজয় র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস উপলড়্গে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে এদিন দলের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের টুঙ্গিপাড়া গমন ও সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। সকাল সোয়া ৬টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশে সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। একই সময়ে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সোয়া ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকেল ৩টায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নগরীতে বিজয় র্যালি। র্যালিটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন থেকে শুরু হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে সমাপ্ত হবে। এ ছাড়া দেশের সকল দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আলোচনা সভা। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন। সভাপতিত্ব করবেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বিবৃতিতে মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে দলের গৃহীত সকল কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সকল নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মহান বিজয় দিবস আজ বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর। আজকের প্রভাতে পূর্ব দিগন্তে যে নতুন সূর্যের উদয় হলো তার রঙ এতো লাল কেন? সেকি ‘হরিদাসী’র সিঁথির সিঁদুর মেখে, নাকি বীর মুক্তিসেনার রক্তের সাগরে স্নাত হয়ে এসেছে বলে? বিজয় আনন্দের, বিজয় গৌরবের, বিজয় মাথা তুলে দাঁড়াবার। কিন্তু বাঙালির বিজয় একাধারে বেদনারও। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে বিজয়- সে তো বেদনার অশ্রুতে সিক্ত হবেই। তবু শত বেদনার মধ্যেও, বিজয় মানেই যে উৎসব। আজ তাই বাঙালির বিজয় উৎসব। ঘরে ঘরে আজ উড়ছে বিজয় কেতন। হৃদয়ে হৃদয়ে স্ফুরিত আনন্দ প্রভা। এই বাংলাদেশ আমাদের, এই স্বাধীনতা আমাদের। বিজয় আমাদের।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির গৌরবময় বিজয়ের ৪০তম দিবস আজ। এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরবের মহিমায় সমুন্নত অনন্য এই দিনটি। এমন একটি দিনের প্রতীড়্গায় এ দেশের মানুষ প্রহরের
পর প্রহর গুনেছে, লড়াই করেছে জীবন বাজি রেখে, ঝরিয়েছে বুকের তাজা রক্ত। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। পূর্ণ হয় মুক্তিপাগল বাঙালির স্বপ্নসাধ। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশের সর্বত্র আজ আনন্দ-উৎসব, শোক ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সম্মিলনে পালিত হবে জাতীয় জীবনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই দিন- ৪০তম বিজয় দিবস।
বাঙালির জাতীয় জীবনে এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন প্রেড়্গাপটে, ভিন্ন মাত্রায়। এবার যখন আমরা বিজয় উৎসব উদযাপন করতে যাচ্ছি তখন দেশ চালাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনায় ঋদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ মাস বয়সী এই সরকার এরই মধ্যে শুরু করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া। চিহ্নিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে গোটা জাতি আজ একাট্টা। এবারের বিজয় দিবসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করবে জাতি। শপথ নেবে একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের নির্মূল করার।
এদিকে, উচ্চ আদালতের রায়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে ’৭২-এর সংবিধান। ফিরে এসেছে সংবিধানের ৪ মূলনীতি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেড়্গতা। বাংলাদেশ আবার ফিরে এসেছে সাংবিধানিকভাবে অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্রের ধারায়। রুদ্ধ হয়েছে ধর্মের জিগির তুলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পথ। এই অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নিঃসন্দেহে এক ধাপ অগ্রগতি।
বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি। বীরত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস এ জাতির গৌরবময় ঐতিহ্যেরই অংশ। তবুও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির জন্মভূমি হয়েছে বহিরাগত শাসক-শোষকদের করতলগত। হানাদার বিদেশী শাসকরা বারবার আক্রমণ ও দখল করেছে এ দেশের শাসনদণ্ড, লুণ্ঠন করেছে সম্পদ, শোষণ-নিষ্পেষণে করেছে জর্জরিত। কিন্তু কোনোভাবেই পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে কেড়ে নিতে। তাই সুযোগ পেলেই এ দেশের মানুষ করেছে বিদ্রোহ। শত্রুর বিশাল শক্তিমত্তা জেনেও অসীম সাহসে নেমেছে অসম লড়াইয়ে। বাঙালির এই লড়াই-সংগ্রামেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই শাসকগোষ্ঠী বাঙালির অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানে। ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা উভয় স্থানেই তাৎড়্গণিকভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ছাত্র সমাজের এ প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস উপলড়্গে আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় পূর্ব বাংলার সচিবালয় ইডেন বিল্ডিংয়ের গেট থেকে পুলিশ শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে নিড়্গেপ করে। দিনে দিনে ছাত্র সমাজের ভাষার অধিকারের এ আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের এক পর্যায়ে কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকেই হতাহত হন। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের’ অনমনীয় এ আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক গোষ্ঠী বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন নিছক একটি ভাষা আন্দোলনই ছিল না। এ আন্দোলন ছিল বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্ব রড়্গার একটি সংগ্রামের সূচনা। এ ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিড়্গা সংকোচন নীতি ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম।
পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোয় বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ সম্ভব নয় বিবেচনা করে মূলত ১৯৬২ সালেই তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তার উন্মেষ ঘটে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এ ছাত্রনেতারা গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির লড়্গ্যে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ ‘স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী পরিষদ’ গঠন করেন সংড়্গেপে যাকে ‘নিউক্লিয়াস’ বলা হতো। ’৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ৬ দফাই ছিল মূলত বাঙালির মুক্তি সনদ। পরবর্তী সময়ে ৬ দফাকে ধারণ করে ছাত্ররা ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ৬ দফা ও ১১ দফা বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। এ সময় পাকিস্তান সরকার মিথ্যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত ও বন্দী করে। এতে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ’৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ড়্গমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার গণদাবিকে উপেড়্গা করতে পারেনি- সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ’৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাংবিধানিক প্রথা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ড়্গমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ড়্গমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ’৭১ সালের ১ মার্চ এক বেতার ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ আহূত পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিগর্ভ ভাষণ, তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- জাতির চূড়ান্ত লড়াই-সংগ্রামের পথ দেখায়। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও।
এদিকে সংকট নিরসনে আলোচনার নামে কালড়্গেপণ শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। এই কালড়্গেপণের সুযোগে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এ দেশে নিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র। তারপর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল অতর্কিত আক্রমণে বাঙালি হতচকিত হয়ে পড়বে, হত্যা নির্যাতনের ভয়ে স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করবে। কিন্তু তারা জানতো না বাঙালির আপোসহীন বীরত্বের ইতিহাস। তারা অনুভব করতে পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা কতোটা তীব্র, অদম্য। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে হতবাক করে দিয়ে সেই কালরাতেই রুখে দাঁড়ায় স্বাধীনতাকামী বাঙালি। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার কোনো পরিমাপ হয় না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মাটি। সম্ভ্রম হারিয়েছেন, চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ লাখ মা-বোন। জাতি এ যুদ্ধে হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যুত্তরে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বিজয় অর্জনের লড়্গ্যকে সামনে রেখে অকুতোভয় বাঙালি জাতি যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তার সমাপ্তি হয় আনন্দ বেদনার সম্মিলনে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর।
২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায় ঢাকাসহ দেশের সবগুলো বড় শহর ও সেনানিবাসে বাঙালি রেজিমেন্টগুলোর ওপর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাত ১২টার পর তার ধানমণ্ডির বাসভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। বন্দী হওয়ার পূর্বে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা অয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে সারা দেশে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লিফলেট আকারে বিলিও করা হয়। পরে ২৭ মার্চ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পড়্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণা বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার প্রচার করা হয়।
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনতার সহযোগিতায় মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু শক্তিশালী, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকতে না পেরে প্রতিরোধ যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল নির্বাচিত সাংসদরা ভারতের আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এ সরকার স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। স্বাধীনতার সনদ বলে এ সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৭ এপ্রিল এই প্রবাসী সরকার মেহেরপুরের ভবেরপাড়ায় (বৈদ্যনাথতলা) আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শপথ গ্রহণের এ স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগরে শপথ নেয় বলে এ সরকার মুজিব নগর সরকার নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এ সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। এ সরকারের নেতৃত্বে এবং বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতায় পরিচালিত হয় দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।
অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙিড়্গত বিজয়। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী তার ৯৩ হাজার সৈন্য এবং বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন ’৭১-এর এই দিনে। আর সেই থেকে এই দিনটি হয়ে ওঠে আমাদের বিজয়ের স্মারক- ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস।
দড়্গ ও শক্তিশালী বলে কথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আজ থেকে ৩৯ বছর আগের এই দিনে বাঙালির দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৌর্য-বীর্যের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সেই মহান বিজয়ের দিন আজ। এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক এসব বাণীতে তারা দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিজয় র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস উপলড়্গে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে এদিন দলের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের টুঙ্গিপাড়া গমন ও সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। সকাল সোয়া ৬টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশে সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। একই সময়ে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সোয়া ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকেল ৩টায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নগরীতে বিজয় র্যালি। র্যালিটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন থেকে শুরু হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে সমাপ্ত হবে। এ ছাড়া দেশের সকল দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আলোচনা সভা। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন। সভাপতিত্ব করবেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বিবৃতিতে মহান বিজয় দিবস উপলড়্গে দলের গৃহীত সকল কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সকল নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।