"যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না"

যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না

যাঁরা বলেন পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না, তাঁরা হয় গোবর গনেশ, না হয় জ্ঞানপাপী-জেনেশুনে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টায় লিপ্ত। কারণ, আমরা সবাই জানি লাহোর প্রস্তাবকেই পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি ধরা হয়। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের আওতায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা যে শুভঙ্করের ফাঁকি এবং বাঙ্গালীদের সাথে এক জঘন্য প্রতারণা ছিল তা ঐ লাহোর প্রস্তাব মনোযোগ সহকারে দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমুহ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমুহ গঠনের প্রস্তাব সম্বলিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত হয়। শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক উক্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মূল প্রস্তাবটি ছিল এরকম,

নো কন্সটিটিউশনাল প্ল্যান উড বি ওয়য়ার্কেবল ওর এক্সেপ্টেবল টু দ্য মুসলিমস্‌ আনলেস জিওগ্রাফিক্যাল কন্টিগিউয়াস ইউনিটস আর ডিমার্কেটেড ইনটু রিজিওন্স হুইচ শুড বি সো কনস্টিটিউটেড উইথ সাচ টেরিটোরিয়াল রিএডজাস্টমেন্টস এজ ম্যায় বি নেসেসারী। দ্যাট দি এরিয়াস ইন হুইচ দ্য মুসলিম্‌স আর নিউমেরিক্যালি ইন ম্যাজরিটি এজ ইন দ্য নর্থ-ওয়েস্টার্ণ এণ্ড ইস্টার্ণ জোন্‌স অব ইণ্ডিয়া শুড বি গ্রুপ্‌ড টু কনস্টিটিউট ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট স্টেট্‌স ইন হুইচ দ্য কনস্টিটিউয়েন্ট ইউনিট্‌স শ্যাল বি অটোনোমাস এণ্ড সভের‍্যনি), যার বঙ্গানুবাদ মোটামুটি এরকম,

“কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়: (ক) ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে 'অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, (খ) প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্ত করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' গঠন করতে পারে, (গ) 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের' সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।“

লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমুহ’ গঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের কায়েমী স্বার্থবাদী চক্র হয় লাহোর প্রস্তাবকে বিকৃত করে অথবা ধর্মের জিগির তোলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বাঙ্গালীদেরকে স্বাধীনতার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের স্বীয় হীন স্বার্থে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে প্রকারান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করেন।

তা ছাড়াও চৌধুরী রহমত আলী ‘পাকস্তান(চঅকঝঞঅঘ)’ নামের যে স্বাধীন মানচিত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেখানে পাঞ্জাবের ‘পি’ ছিল, আফগান সীমান্তের ‘এ’ ছিল, কাশ্মীরের ‘কে’ ছিল, সিন্ধুর ‘এস’ ছিল এবং বেলুচিস্তানের ‘তান’ ছিল; তৎকালীন বাংলার কোনো অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। এত্থেকেও পরিষ্কার যে তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত না করে তথাকথিত প্রদেশ নামের আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া হয়।

আমাদের দূর্ভাগ্য যে, জাতির বিরুদ্ধে ইতিহাসের এমন হীন ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা কিংবা নিজ জনগণকে জাগ্রত করে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাওনা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মতো বলিষ্ট, বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কোনো বাঙ্গালী নেতৃত্বের উদ্ভব তখন ঘটেনি। যদিও অনেক বাঙ্গালী নেতা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কাজেই যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আমরা সময়মত স্বাধীনতা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছি, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং পাকিস্তান হতো কি হতো না, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার কোনো প্রয়োজন হতো না; যোগ্য নেতৃত্ব থাকলে লাহোর প্রস্তাবের আওতায় ১৯৪৭ সালেই পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটত।

১৭৫৭ সালের ২৩জুন মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়। তারপর ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরে আমাদের দেশে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, জানা অজানা অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরেছে। আমাদের অঞ্চলে নীল বিদ্রোহ হয়েছে, ফরায়জী আন্দোলন হয়েছে, ওহাবী অন্দোলন হয়েছে, তেভাগা আন্দোলন হয়েছে, নারকেল বাড়িয়ায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার বিদ্রোহ হয়েছে, সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত ১৮৫৭ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে, নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ হয়েছে। আরো ছোট বড় কত সংগ্রাম হয়েছে। সকল সংগ্রামেরই মূল লক্ষ্য ছিল স্বদেশভূমির স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু কোনো আন্দোলন, কোনো সংগ্রামই তার চুড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। তৎকালীন শাষক গোষ্ঠী অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে সকল আন্দোলন সংগ্রামকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে।

তারপর ‘কান মে বিড়ি মু মে পান, লেড়কে লেংগে পাকিস্তান’ বলে তথাকথিত দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে আমাদেরকে মেকি স্বাধীনতার নাম করে নূতনভাবে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করা হয়। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্তি যে আমাদের একটি ঐতিহাসিক ভূল ছিল তা বুঝতে যেমন বাংগালীদের দেরী হয় নি, তেমনি স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সূত্রপাত হতেও বেশী সময় লাগেনি।

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। সেটা হচ্ছে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ঠিক ১৯২ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এ দল প্রতিষ্ঠিত হয়, যে দল এবং তার সুযোগ্য নেতা বাঙ্গালীর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে চুড়ান্ত সংগ্রামের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে স্বাধীনতার লাল সূর্য্য ছিনিয়ে এনে একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন এর চুড়ান্ত পরিণতি যে স্বাধীন বাংলাদেশ এ কথা মাথায় রেখেই তা করেছিলেন। নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শ্তা দিয়ে তিনি অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন যে, চুড়ান্ত সংগ্রামের জন্য বাঙ্গালীরা ততদিনে প্রস্তুত হয়ে গেছে। তাইতো তিনি ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপোষ করেননি এবং কোনো ছাড় ও দেননি। বরং সে আন্দোলনে তীব্র গতি সঞ্চারিত করে জাতিকে চুড়ান্ত সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে সফলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এজন্যেই ছয় দফাকে বাঙ্গালীর মুক্তি সনদ বলা হয়।

শুধু কর্মসূচী দিয়ে সফল আন্দোলন হয় না। কর্মসূচীকে জনপ্রিয় করে তোলার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণকে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে চুড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার মত সফল নেতৃত্ব দানের মধ্যেই আন্দোলনের মূল সফলতা নির্ভর করে। ছয় দফা থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহই তার বাস্তব উদাহরণ। পুরো একটা জাতিকে স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার চেতনায় জাগ্রত করে তোলে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চুড়ান্ত সফলতা ছিনিয়ে আনতে যে বলিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার দরকার, তেমন নেতা বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে একজনই জন্মেছিলেন, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাইতো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, ইতিহাসের রাখাল রাজা, বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির জনক। যৌবনের সতেরটি বছর তিনি কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন, চরম শারিরিক মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমূখি হয়েছেন, কিন্তু মাথা নত করেননি কখনো। কারণ তিনি বাংলাকে ভালবাসতেন, বাঙ্গালীকে ভালবাসতেন।

তাঁর নেতৃত্বেই আমরা একটা পতাকা পেয়েছি, নিজেদের একটা মানচিত্র পেয়েছি, একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি এবং একটা স্বাধীন জাতির পরিচয় নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। বাংলার ইতিহাসে স্বাধিকার আর স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনেক আন্দোলন হয়েছে, অনেক সংগ্রাম হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই চুড়ান্ত সফলতা লাভ করতে পারেনি। কারন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব সেখানে ছিল না। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।

আমাদের চরম দূর্ভাগ্য যে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক হীন চক্রান্ত থেকে তাঁকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। সপরিবারে তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়, যা জাতি হিসেবে আমাদের কপালে অকৃজ্ঞতা আর কলংকের কালিমা লেপন করে দিয়ে গেছে। অহর্নিশ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাভরে তাঁকে স্মরণ করি এবং ইতিহাসের জঘন্যতম কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের আতর মাগফেরাত কামনা করি।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day