৬৩ বছরে আওয়ামী লীগ

৬৩ বছরে আওয়ামী লীগ



আওয়ামী লীগের ৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন।


১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়।

দলটি বৃহস্পতিবার ৬৩ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "ছয় দশকেরও বেশি কাল ধরে পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ম্ুিক্তযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক এবং সাধারণ মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সুমহান গৌরব অর্জন করেছে।" তিনি আওয়ামী লীগ গঠনে এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদন স্মরণ করেন। প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষে রাজধানীসহ সারা দেশে রঙিন পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড টানানো হয়েছে। ২৩ জুন (বৃহস্পতিবার) ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে ৭ টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবেন দলের শীর্ষ নেতারা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা আওয়ামী লীগের।
যেভাবে প্রতিষ্ঠা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা এবং অসা¤প্রদাায়িক চেতনার ধারাবাহিকতায় সংগঠনটির নাম থেকে পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান।



শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার মুকুল প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এরপর, ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

আওয়ামী লীগই ছিলো তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল। জন্মলগ্ন থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পাকিস্তান আমলের গোড়ার রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বিলোপ ছিল দলটির প্রধান দাবিগুলোর অন্যতম। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টি মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

১৯৫৪ সালের মার্চের মাসের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়।

এরমধ্যে, ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ ও অসা¤প্রদায়িক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। সংকট ও গণ আন্দোলন পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দল ভাঙনের ফলে আওয়ামী লীগ সংকটে পড়ে। ওই বছরের সাত ও আট ফেব্র"য়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৬ সালের ফেব্র"য়ারিতে লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে তিনি ছয় দফা উপস্থাপন করেন। এর জবাবে আইয়ুব সরকার তাকেসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৬তে গণআন্দোলন শুরু হয় এবং আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ওই বছরের ২২ ফেব্র"য়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্তে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার।

পরদিন তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়াদী উদ্যান) সংবর্ধনায় তাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

গণআন্দোলন ও আইয়ুবের পতনের পটভূমিতে '৭০ এর নির্বাচনে কেন্দ্রিয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ আসনে জয়ী হয়।

অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়। ৭১'র মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের ডাকে জনগণ সর্বাত্মকভাবে সাড়া নেয়। ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।

বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় আওয়ামী লীগকে। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন লাভ করে দলটি।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একটি মাত্র জাতীয় দল 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ' (বাকশাল) গঠনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটানো হয়।

'৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর সামরিক সরকার রাজনৈতিক দল প্রবিধান ঘোষণা করলে ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটে। আওয়ামী লীগ সম্মেলন করে প্রবাসে থাকা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দলের দায়িত্ব নেন। এর আগে, জিয়াউর রহমানের অধীনে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে জয় লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ '৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ৭৬টি আসন পায়। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮৮ আসনে জয়ী হয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে।
'৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আওয়ামী লীগ একই বছর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৪৬টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চারদলীয় জোটের কাছে পরাজিত হয়ে ফের বিরোধী দলে চলে আসে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোটের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয়করণের অভিযোগ, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা, ১১ জানুয়ারি ক্ষমতায় পালাবদল ও বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আওয়ামী লীগের সমর্থন, পরবর্তীতে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার ও চিকিৎসার জন্য ১১ জুন সাময়িক মুক্তি সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়েও বেশ চড়াই উতড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে। ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে আওয়ামী লীগ পায় ২৩৩টি আসন। পরে, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলটির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

ব্রিগেডিয়ার বারীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা