সেরনিয়াবাতের বাসায় গুলিবিদ্ধ : সেই রাতের কথা মনে হলে আঁতকে ওঠেন ডা. জিল্লুর



সেরনিয়াবাতের বাসায় গুলিবিদ্ধ : সেই রাতের কথা মনে হলে আঁতকে ওঠেন ডা. জিল্লুর








ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বেঁচে থাকা ডা. খ ম জিল্লুুর রহমান এখনো রাতে আঁতকে ওঠেন। ১৫ আগস্টের সেই বিভীষিকাময় রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বারবার প্রিয় নেতার কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই রাতের ভয়াল ও লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ঘাতকরা এতোই পাষাণ যে তারা বঙ্গবন্ধুর ছোট শিশু সন্তান শেখ রাসেল ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর শিশুপুত্র সুকান্ত বাবুকেও ওরা বাঁচিয়ে রাখেনি। নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করেছে। ডা. জিল্লুুর বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার ৪০ বছর পর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন দেখতে পেয়ে আমার কাছে ভালো লেগেছে।



যে বঙ্গবন্ধু না হলে দেশ স্বাধীন হতো না, আমরা বাংলাদেশ পেতাম না। সেই স্বাধীনতার স্থপতির খুনিদের বিচারে এতো বিলম্ব হওয়াটা জাতির জন্য বড় বেদনাদায়ক। গত ১৪ আগস্ট পবিত্র মাহে রমজানের তারাবির নামাজ আদায়ের পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মর্মস্পর্শী ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল রাতের বর্ণনা করেন তিনি। তিনি বলেন, তৎকালীন মন্ত্রী কামরুজ্জামান বরিশাল এলে ক্রিডেন্স ব্যান্ড তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা প্রদান করে। মন্ত্রী কামরুজ্জামান ক্রিডেন্স ব্যান্ডের গানে মুগ্ধ হয়ে ব্যান্ড দলকে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং শিল্পীদের বেতারে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। মন্ত্রীর আশ্বাসে ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের ১০ সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী আঃ রব সেরনিয়াবাতের বাসায় ওঠেন।



ওই দলের নেতৃত্ব দেন বরিশাল অপসোনিনের বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর আঃ রউফ খান নান্টু। তার নেতৃত্বে ওই প্রতিনিধিদল ১৪ আগস্ট বিকালে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় মিলাদে অংশগ্রহণ করেন। ডা. জিল্লুর বঙ্গবন্ধুর হাতে মিলাদের তবারক তুলে দেন। জিল্লুুর বলেন, রাতে মন্ত্রী কামরুজ্জামানের বাসায় একটি শিশুর জন্মদিনে আমরা ব্যান্ড দল অংশগ্রহণ করি। আমাদের ব্যান্ড দলের গানে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই পুরস্কৃত করেন। আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ড দল সেখান থেকে চলে এসে আঃ রব সেরনিয়াবাতের বাসার নিচতলার ফ্লোরে ঘুমানোর আয়োজন করি। ১৫ আগস্ট ভোররাতে হঠাৎ গুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তিনি সবাইকে ভেতরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ থাকবে বলে চলে গেলেন দোতালায়। আমিসহ সবাই ভয়ে কাতর হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে সেনা সদস্যরা অস্ত্র হাতে বাড়ি ঘিরে রেখেছে। অল্প সময় পরই যে রুমে আমরা প্রথম শুয়েছিলাম সৈনিকরা সেই রুমের কাঁচের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছোড়ে।



সৈনিকরা অনেকে উর্দুতে গালাগাল করে আমাদের রুমের দরজা খুলতে নির্দেশ দেয়। কিছু সময় পরে আমি দরজা খুলে দিলে একজন সৈনিক ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা সৈয়দ গোলাম মাহমুদ ওই সৈনিকের পা জড়িয়ে ধরে বলেন, স্যার আমরা এই বাসার কেউ নই, আমরা এখানে গান গাইতে এসেছি। তখন ওই সৈনিক আমাদের সবাইকে ‘ফরোয়ার্ড’ বলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় দেখতে পাই দোতালা থেকে আঃ রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবার বর্গকে সৈনিকরা নিচে নিয়ে আসছে। ওই সময় আঃ রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবিকে একজন মেজরের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেছি। বেবিকে বলতে শুনেছি আপনারা কারা? কেন আপনারা এ বাসায় এসেছেন ? আপনারা জানেন এ বাসা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতির বাসা। সৈনিকরা সবাইকে নিচতলায় ড্রইং রুমে নিয়ে আসে। ড্রইং রুমে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের ৮-১০ জনসহ মোট ৩০-৩২ জন অবস্থানকালীন দেখতে পাই বাইরে প্রচ- গুলি হচ্ছে। এ সময় একজন সৈনিক ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ ফায়ার করছেন। একে একে অনেককেই লুটিয়ে পড়তে দেখে আমি বাঁচার জন্য প্রাণপণে আল্লাহকে ডাকতে থাকি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার শরীরের নিচের অংশে অনেকগুলো গুলি লাগে (পরে জানতে পারি ১৩টি)। আমি নিচে লুটিয়ে পড়ি। তখনো আমার হুশ ছিল। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। ওই সৈনিক একাই পরপর ৩টি অস্ত্র দিয়ে রুমের মধ্যে ব্রাশ ফায়ার করলো। সবাই লুটিয়ে পড়ার পর অন্য একজন সৈনিক ১টি রিভলবার নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অনেকের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে। আমার ডান হাতে ২টি ও বাম হাতে ২টি গুলি করে। আজ আমি ১৭টি গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ওই সৈনিক রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর কে যেন আমাকে টেনে হিঁচড়ে ড্রইং রুমের সোফার নিচে ঢুকিয়ে দেয়। যাদের গায়ে গুলি লাগেনি তারা সৈনিকরা চলে যাওয়ার পর পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আমাদের রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার স্ত্রীর গায়েও গুলি লাগে। এ সময় হাসানাত ভাইকে চলে যেতে অনুরোধ করি। তখন তিনি ওই বাড়ি থেকে চলে যান। সকাল হলে রমনা থানার ওসি এসে সবাইকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই মর্মস্পর্শী হত্যাকা-ে আমার সঙ্গে থাকা আবু নঈম খান রিন্টু গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপের সৈয়দ গোলাম মাহমুদ, বাবু ললিত কুমার দাস, রফিকুল ইসলাম পিন্টু, দিলীপ দাও গুলিবিদ্ধ হন। আমাদের সঙ্গে থাকা লে. কর্নেল (অব.) কায়জার, জন মাইকেল চৌধুরী ও মুকুল দাসের গায়ে গুলি লাগেনি। ওই ভয়াল রাতের দৃশ্য আজো মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। রাতে মাঝে মধ্যে এখনো আঁতকে উঠি।

Popular posts from this blog

THE CONSTITUTION OF THE BANGLADESH AWAMI LEAGUE

ইতিহাসবন্ধনী

Justice order of the day