ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছু সময়: শেখ হাসিনা
নভেম্বর ২, ২০১০
২৫ বৈশাখ ১৪১৭, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। যাবার পথে দেখলাম, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চানখারপুল হয়ে আমার গাড়ী কারাগারের প্রধান ফটকে পৌঁছাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়েছি। ১৯৫৪ সাল থেকে আমরা তখন ঢাকায় বসবাস শুরু করি তখন থেকেই এই রাস্তায় যাতায়াত আমাদের জন্য এক রকম নিয়মিত ছিলই বলা যায়।
১৯৫৪ সালে আব্বা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় শাসন চালু হলে ৯২ ক ধারা দিয়ে জরুরী অবস্থা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হয়। নেতাদের গ্রেফতার শুরু হয়। তখন আব্বাও বন্দি হলেন। সাথে আরও অনেক মন্ত্রী, এমপি। শেরে-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকও তখন বন্দি হন।
সেই থেকেই জেলখানায় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতাম আমি, কামাল ও ছোট্ট জামাল। আমরা মায়ের হাত ধরে আব্বার সাথে দেখা করতে আসতাম। মাসে দু’বার দেখা করার সুযোগ পেতাম। তার আগেও আব্বা জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বহুবার জেলে গেছেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তাঁর জীবন। তারপরও ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১, বার বার গ্রেফতার হয়েছেন।
সেই জেলখানায় যাচ্ছি। আমরা গেটে পৌঁছলাম। গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়ী ভিতরে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে গাড়ীতে বেগম সাজেদা চৌধুরী। আমরা নামলাম। আইজি প্রিজন স্বাগত জানালেন। জেল সুপার, জেলারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা আপা ও স্বরাষ্ট্র সচিব এবং অন্যান্য সকলেও আছেন।আমার বার বার রেহানার কথা মনে পড়ছিল। ওকে সাথে নিয়েই আমার আসার কথা। জেলখানায় দুই বোন এক সাথে আসব এটাই ছিল আমার চিন্তা। কিন্তু আজ রেহানাকে ছেড়ে এসে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। যেখানে গাড়ীটা থেমেছে, এই রাস্তা দিয়ে আব্বা হেঁটে আসতেন জেল গেটে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে। আজ আমি সেই রাস্তায়।
গার্ড অব অনার হল। আমাদের সেই জায়গায় যেটা দেওয়ানী বলে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটি বেদী করা হয়েছে, সেই বেদীতে ফুল দিলাম। শামীম শিকদারের নির্মাণ করা ভাস্কর্য এখানে একটা স্তম্ভের উপর স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টা স্তম্ভের মাঝে মধ্যের স্তম্ভে ভাস্কর্যটা রাখা। বাকিগুলি জলের ফোয়ারা, পানি নামছে বিরাট জলাধারে, টলটলে পানি।
কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা দেবার অপরাধে বাবা আবার গ্রেফতার হন এবং তাঁকে রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নিঃসঙ্গ এই কারাগারে বইপড়া, বাগান করাই ছিল একমাত্র অবসর। গান শোনার জন্য একটা টেপ রেকর্ডারের আবেদন করেও পাননি। তাঁকে মানসিক নির্যাতন করাই ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের উদ্দেশ্য। বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারী জেলখানা থেকেই পুনরায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় আব্বাকে। এরপর ১৯ জুলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। মামলা শুরু হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস আমরা জানতেই পারি নাই আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
একটা দেশের মানুষের জন্য একজন মানুষ কতখানি কষ্ট করতে পারে, কীভাবে জীবন বিপন্ন করতে পারে, দিনের পর দিন যাতনা ভোগ করেও মানসিক শক্তি সবল রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে- তা এখানে এলেই বোঝা যায়। বাংলার মানুষকে গভীরভাবে তিনি ভালোবাসতেন। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। দরিদ্র মানুষের কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার মানুষের মুক্তি কীভাবে দেবেন সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসাই তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। এতো কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতাও তিনি পান দেশের জনগণের ভাগ্য ফেরাবার লক্ষ্যে।
যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সাথে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেতো। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইতো না। এরপর রেহানা যখন আসতো, একই অবস্থা হতো, কিছুতেই আসতে চাইতো না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ আদর ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সাথে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা তাকে বোঝাতেন যে, এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মা’র সাথে তোমার বাসায় যাও। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কি তা শুনতো, জিদ ধরতো, কান্নাকাটি করতো। বাসায় এসে বার বার মাকে জিজ্ঞেস করতো, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাক।
কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্য।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি। এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামে অংশ নিয়ে জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন। এই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টা ঘাতকের দল মেনে নিতে পারে নাই। যে কারণে পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আর ৩রা নভেম্বর জেলখানায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দালালরা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এই জিঘাংসা চরিতার্থ করে। জাতি চিরদিন এই খুনী ও ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণা করে যাবে।
সেখান থেকে ফেরার পথে মহিলা ওয়ার্ডে গেলাম। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, দিপ্তী আমার সঙ্গে ছিল। অনেকেই এই কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছে। তাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কারারক্ষী যেসব সাব জেলে আমার ডিউটি করেছে তাদের সাথেও দেখা হল। সেখান থেকে গেটে আসলাম। যে কামরায় বসতে দিল এই কামরায় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আমার আক্দ হয় ড. এম. এ. ওয়াজেদের সাথে। কয়েকদিন পর ইন্টারভিউর অনুমতি পেলে মা আমাকে ও ড. ওয়াজেদকে এখানে নিয়ে আসেন। জেলখানার ফুল দিয়ে আব্বা দুটো মালা তৈরী করেন, বিয়ের প্রথম ফুলের মালা আব্বার হাত থেকে পেলাম। আব্বা মালা পরিয়ে কন্যা সম্প্রদান করেন এই কামরায়। সেই জায়গায় আজ এসে বসলাম।
এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে সেই ঘোষণা দিলাম। বের হবার পথে দেখতে গেলাম অন্য একটি কামরা। সেখানে সব সময় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ হত। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশের কামরায় পেলাম সেই টেবিলটা। গোল গোল পায়া দেয়া একটা টেবিল। এখনও আছে। আমরা ছোটবেলায় ঐ টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসতাম। জামাল খুব ছোট ছিল, ঐ টেবিলের উপরই বসিয়ে দিলে খেলা করত। এরপর রেহানা এলো আমার মায়ের কোলজুড়ে। রেহানাও খেলা করেছে ঐ টেবিলে। কারণ আব্বা তো বার বারই জেলে বন্দী হয়েছেন। এরপর ছোট্ট রাসেল এলো আমার মায়ের কোলে। আমাদের সকলের আদরের ছোট্ট রাসেলও ঐ টেবিলে বসে খেলা করেছে। পিছনে টিনের শেড দেয়া বারান্দা এখনও ঐ রকমই আছে। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন আব্বা আসবেন। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। জেল গেটে আসার পর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অনুমতি এলে ভিতরে গিয়ে বসতাম। আমাদের ভিতরে বসিয়ে তারপর আব্বাকে আনতে যেত। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য দেখা পেতাম। এর বেশি অনুমতি ছিল না। মা ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে নিয়ে যেতেন, সাথে কিছু নাস্তা। আমরা যেখানে বসতাম, সেখানেও দু’জন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। কি কথা হয় না হয় বোধ হয় তা উপরে জানাবার কাজই তাদের ছিল।
বিকাল পাঁচটা থেকে প্রায় পৌনে ৭টা পর্যন্ত কারাগারে ছিলাম। সকল বন্দীদের জন্য বড়খানা দেবার নির্দেশও দিয়ে এলাম। এখানে এসে বার বার একথাই মনে হচ্ছিল, আব্বা বাংলার মানুষকে এত ভালবাসতেন। নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ, চাওয়া পাওয়া সব বিসর্জন দিয়ে এই দুঃসহ কষ্টকে আলিঙ্গন করেছেন, শুধু একটাই কারণে- তা হল বাংলার মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা। নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। আমার মা ছায়ার মত সারাজীবন তাঁকে অনুসরণ করে গেছেন, কোন চাওয়া পাওয়া তার ছিল না। স্বামীকে কতটুকু পেয়েছেন? বছরের পর বছর তো তার জেলে কেটেছে, আর বাইরে থাকলে আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। ঘর সংসার ছেলেমেয়ে সব দায়িত্ব আমার মা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন যেন স্বামী তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।
আমার দাদা দাদির কথা খুব মনে পড়ছে। তারাও এই কারাগারে এসে বন্দি সন্তানকে দেখে গেছেন। আমার আব্বা খুবই সৌভাগ্যবান ছিলেন যে এমন পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। রত্নগর্ভা আমার দাদি। আব্বার প্রতিটি কাজে সহায়তা করেছেন। শক্তি সাহস জুগিয়েছেন আর্থিক সহায়তা করেছেন। ছেলে দেশের ও দশের জন্য কাজ করছেন। বাংলার গরিব মানুষের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, এ গর্ব তাঁদের ছিল। কখনও আমার দাদা-দাদি আব্বার কাজে বাঁধা দেন নাই বরং উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। এমন বাবা-মা না হলে, তাদের দোয়া না থাকলে, মানুষ কি এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? পারে না। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষের কল্যানের জন্য গোটা পরিবারকেই আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তবেই না আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
আজ স্বাধীনতা সকলে ভোগ করছে, কিন্তু এর পিছনে কত মানুষের কত ত্যাগ, কত কষ্ট, কত সাধনা তা কি কেউ মনে রাখে?
২৫ বৈশাখ ১৪১৭, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। যাবার পথে দেখলাম, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চানখারপুল হয়ে আমার গাড়ী কারাগারের প্রধান ফটকে পৌঁছাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়েছি। ১৯৫৪ সাল থেকে আমরা তখন ঢাকায় বসবাস শুরু করি তখন থেকেই এই রাস্তায় যাতায়াত আমাদের জন্য এক রকম নিয়মিত ছিলই বলা যায়।
১৯৫৪ সালে আব্বা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় শাসন চালু হলে ৯২ ক ধারা দিয়ে জরুরী অবস্থা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হয়। নেতাদের গ্রেফতার শুরু হয়। তখন আব্বাও বন্দি হলেন। সাথে আরও অনেক মন্ত্রী, এমপি। শেরে-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকও তখন বন্দি হন।
সেই থেকেই জেলখানায় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতাম আমি, কামাল ও ছোট্ট জামাল। আমরা মায়ের হাত ধরে আব্বার সাথে দেখা করতে আসতাম। মাসে দু’বার দেখা করার সুযোগ পেতাম। তার আগেও আব্বা জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বহুবার জেলে গেছেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তাঁর জীবন। তারপরও ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১, বার বার গ্রেফতার হয়েছেন।
সেই জেলখানায় যাচ্ছি। আমরা গেটে পৌঁছলাম। গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়ী ভিতরে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে গাড়ীতে বেগম সাজেদা চৌধুরী। আমরা নামলাম। আইজি প্রিজন স্বাগত জানালেন। জেল সুপার, জেলারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা আপা ও স্বরাষ্ট্র সচিব এবং অন্যান্য সকলেও আছেন।আমার বার বার রেহানার কথা মনে পড়ছিল। ওকে সাথে নিয়েই আমার আসার কথা। জেলখানায় দুই বোন এক সাথে আসব এটাই ছিল আমার চিন্তা। কিন্তু আজ রেহানাকে ছেড়ে এসে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। যেখানে গাড়ীটা থেমেছে, এই রাস্তা দিয়ে আব্বা হেঁটে আসতেন জেল গেটে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে। আজ আমি সেই রাস্তায়।
গার্ড অব অনার হল। আমাদের সেই জায়গায় যেটা দেওয়ানী বলে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটি বেদী করা হয়েছে, সেই বেদীতে ফুল দিলাম। শামীম শিকদারের নির্মাণ করা ভাস্কর্য এখানে একটা স্তম্ভের উপর স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টা স্তম্ভের মাঝে মধ্যের স্তম্ভে ভাস্কর্যটা রাখা। বাকিগুলি জলের ফোয়ারা, পানি নামছে বিরাট জলাধারে, টলটলে পানি।
কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা দেবার অপরাধে বাবা আবার গ্রেফতার হন এবং তাঁকে রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নিঃসঙ্গ এই কারাগারে বইপড়া, বাগান করাই ছিল একমাত্র অবসর। গান শোনার জন্য একটা টেপ রেকর্ডারের আবেদন করেও পাননি। তাঁকে মানসিক নির্যাতন করাই ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের উদ্দেশ্য। বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারী জেলখানা থেকেই পুনরায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় আব্বাকে। এরপর ১৯ জুলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। মামলা শুরু হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস আমরা জানতেই পারি নাই আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
একটা দেশের মানুষের জন্য একজন মানুষ কতখানি কষ্ট করতে পারে, কীভাবে জীবন বিপন্ন করতে পারে, দিনের পর দিন যাতনা ভোগ করেও মানসিক শক্তি সবল রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে- তা এখানে এলেই বোঝা যায়। বাংলার মানুষকে গভীরভাবে তিনি ভালোবাসতেন। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। দরিদ্র মানুষের কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার মানুষের মুক্তি কীভাবে দেবেন সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসাই তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। এতো কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতাও তিনি পান দেশের জনগণের ভাগ্য ফেরাবার লক্ষ্যে।
যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সাথে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেতো। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইতো না। এরপর রেহানা যখন আসতো, একই অবস্থা হতো, কিছুতেই আসতে চাইতো না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ আদর ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সাথে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা তাকে বোঝাতেন যে, এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মা’র সাথে তোমার বাসায় যাও। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কি তা শুনতো, জিদ ধরতো, কান্নাকাটি করতো। বাসায় এসে বার বার মাকে জিজ্ঞেস করতো, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাক।
কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্য।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি। এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামে অংশ নিয়ে জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন। এই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টা ঘাতকের দল মেনে নিতে পারে নাই। যে কারণে পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আর ৩রা নভেম্বর জেলখানায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দালালরা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এই জিঘাংসা চরিতার্থ করে। জাতি চিরদিন এই খুনী ও ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণা করে যাবে।
সেখান থেকে ফেরার পথে মহিলা ওয়ার্ডে গেলাম। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, দিপ্তী আমার সঙ্গে ছিল। অনেকেই এই কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছে। তাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কারারক্ষী যেসব সাব জেলে আমার ডিউটি করেছে তাদের সাথেও দেখা হল। সেখান থেকে গেটে আসলাম। যে কামরায় বসতে দিল এই কামরায় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আমার আক্দ হয় ড. এম. এ. ওয়াজেদের সাথে। কয়েকদিন পর ইন্টারভিউর অনুমতি পেলে মা আমাকে ও ড. ওয়াজেদকে এখানে নিয়ে আসেন। জেলখানার ফুল দিয়ে আব্বা দুটো মালা তৈরী করেন, বিয়ের প্রথম ফুলের মালা আব্বার হাত থেকে পেলাম। আব্বা মালা পরিয়ে কন্যা সম্প্রদান করেন এই কামরায়। সেই জায়গায় আজ এসে বসলাম।
এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে সেই ঘোষণা দিলাম। বের হবার পথে দেখতে গেলাম অন্য একটি কামরা। সেখানে সব সময় আব্বার সাথে সাক্ষাৎ হত। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশের কামরায় পেলাম সেই টেবিলটা। গোল গোল পায়া দেয়া একটা টেবিল। এখনও আছে। আমরা ছোটবেলায় ঐ টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসতাম। জামাল খুব ছোট ছিল, ঐ টেবিলের উপরই বসিয়ে দিলে খেলা করত। এরপর রেহানা এলো আমার মায়ের কোলজুড়ে। রেহানাও খেলা করেছে ঐ টেবিলে। কারণ আব্বা তো বার বারই জেলে বন্দী হয়েছেন। এরপর ছোট্ট রাসেল এলো আমার মায়ের কোলে। আমাদের সকলের আদরের ছোট্ট রাসেলও ঐ টেবিলে বসে খেলা করেছে। পিছনে টিনের শেড দেয়া বারান্দা এখনও ঐ রকমই আছে। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন আব্বা আসবেন। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। জেল গেটে আসার পর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অনুমতি এলে ভিতরে গিয়ে বসতাম। আমাদের ভিতরে বসিয়ে তারপর আব্বাকে আনতে যেত। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য দেখা পেতাম। এর বেশি অনুমতি ছিল না। মা ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে নিয়ে যেতেন, সাথে কিছু নাস্তা। আমরা যেখানে বসতাম, সেখানেও দু’জন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। কি কথা হয় না হয় বোধ হয় তা উপরে জানাবার কাজই তাদের ছিল।
বিকাল পাঁচটা থেকে প্রায় পৌনে ৭টা পর্যন্ত কারাগারে ছিলাম। সকল বন্দীদের জন্য বড়খানা দেবার নির্দেশও দিয়ে এলাম। এখানে এসে বার বার একথাই মনে হচ্ছিল, আব্বা বাংলার মানুষকে এত ভালবাসতেন। নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ, চাওয়া পাওয়া সব বিসর্জন দিয়ে এই দুঃসহ কষ্টকে আলিঙ্গন করেছেন, শুধু একটাই কারণে- তা হল বাংলার মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা। নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। আমার মা ছায়ার মত সারাজীবন তাঁকে অনুসরণ করে গেছেন, কোন চাওয়া পাওয়া তার ছিল না। স্বামীকে কতটুকু পেয়েছেন? বছরের পর বছর তো তার জেলে কেটেছে, আর বাইরে থাকলে আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। ঘর সংসার ছেলেমেয়ে সব দায়িত্ব আমার মা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন যেন স্বামী তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।
আমার দাদা দাদির কথা খুব মনে পড়ছে। তারাও এই কারাগারে এসে বন্দি সন্তানকে দেখে গেছেন। আমার আব্বা খুবই সৌভাগ্যবান ছিলেন যে এমন পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। রত্নগর্ভা আমার দাদি। আব্বার প্রতিটি কাজে সহায়তা করেছেন। শক্তি সাহস জুগিয়েছেন আর্থিক সহায়তা করেছেন। ছেলে দেশের ও দশের জন্য কাজ করছেন। বাংলার গরিব মানুষের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, এ গর্ব তাঁদের ছিল। কখনও আমার দাদা-দাদি আব্বার কাজে বাঁধা দেন নাই বরং উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। এমন বাবা-মা না হলে, তাদের দোয়া না থাকলে, মানুষ কি এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? পারে না। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষের কল্যানের জন্য গোটা পরিবারকেই আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তবেই না আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
আজ স্বাধীনতা সকলে ভোগ করছে, কিন্তু এর পিছনে কত মানুষের কত ত্যাগ, কত কষ্ট, কত সাধনা তা কি কেউ মনে রাখে?